ছোটোগল্প: আমার বিয়ে

মেয়েপক্ষের লোক আমাকে দেখতে এসেছে।বেশ আগের কথা; ১ জুলাই; ২০০৬ খ্রি.। মেয়ের মামা, খালু, বাবা, চাচী, চাচাতো ভাই এবং খালাতো বোন এসেছিলো। আগে জানতাম ছেলেপক্ষ আগে প্রস্তাব নিয়ে যায়। তখন হয়তো যুগ বদলে যেতে শুরু করেছিলো। মেয়েপক্ষই আগে এসেছিলো। মেয়ের পরিচয় একটু দিই। মেয়ের বিয়ে হয়েছিলো ২০০৪ এ। বিয়ের দিনেই কনেকে বাড়ি নেওয়ার পথেই তার নতুন জামাই এর স্ট্রোক হয়। হাসপাতালে নিতে নিতেই তার জামাই মারা যায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এবং বিধাতার কঠোর পরীক্ষায় এই মেয়েটা সেদিন পতিত হয়েছিলো। তারপর থেকে মেয়েটা আর কথা বলে নি। বাকরুদ্ধ মেয়েকে কে বিয়ে করবে? দিন যায়, বছর যায়। ব্যবসায়িক কাজে মেয়েটার ভাই এর কাছে গিয়েছিলাম। সেদিনই মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিলাম। অসম্ভব রূপবতী। নাস্তা দিতে আমার দিকে আসাতেই তাকে সালাম দিলাম। সালামের উত্তর না নিয়েই বিষন্ন মনে চলে গেলো। আমার বেশ খারাপ লাগলো। পরে মেয়ের ভাই আসলো। ব্যবসায়িক আলাপের ফাঁকে তার বোনের বিষয়টা জানতে চাইলাম-

মেয়ের ভাই: আমার বোনটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বিয়ের দিনই ওর জামাই স্ট্রোক করে মারা যায়। সেই থেকে একটা অপরাধবোধ কিংবা মানসিক যন্ত্রনায় কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কারও সাথেই আর কথা বলে নি সেদিনের পরে। ডাক্তারও তেমন কিছু করতে পারছে না।
আমি: খুব খারাপ লাগলো ভাই। আপনি বরং আপনার বোনের বিয়ে দিন। একসময় ঠিক হয়ে যাবে।
মেয়ের ভাই: কিভাবে সম্ভব? বাকরুদ্ধ বোনকে কে বিয়ে করবে? তাছাড়া ও মানসিকভাবেও তো ফিট না।
আমি: কিছু মনে না করলে. একটি প্রস্তাব দিতে চাই। আমি বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছি। আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকলে আমার পরিবারের সাথে কথা বলতে পারেন।
মেয়ের ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। এক ধরণের কৃতজ্ঞতাবোধ তার চোখে-মুখে।

ঘরগুলো গিজগিজ করছিলো মানুষের কোলাহলে। শৈশবে বিয়ে নিয়ে যতটা হৈহুল্লোড় ছিলো, সেদিন তেমন মনে হচ্ছিলো না। ব্যবসা আর লেখালেখিতেই কেবল মন পড়ে থাকতো। কোনোভাবেই যেনো আমার অবসর মেলে না। তখন মনে হচ্ছিলো বারবার, বিয়ের পর কি আর সেভাবে কলম ধরতে পারবো? সেই অবসর কি আর পাওয়া যাবে? এমনটা ভাবতে ভাবতে আমার চাচাতো বোন মিথিলা আমাকে ডাকছে-
মিথিলা: অনির্বান ভাইয়া, তুমি এখনও পাঞ্জাবী পরো নি? আর তোমার লম্বা দাড়ি না কেটেই মেয়েপক্ষের সামনে যাবা?
আমি: পাঞ্জাবীই বা পরতে হবে কেনো? টি-শার্টে সমস্যা কি? আমাকে নিয়ে তোর এতো চিন্তা করতে হবে না।
মিথিলা রাগ করে বাইরে চলে গেলো। এর মধ্যে শেভ করে পাঞ্জাবী পরে বসে আছি। খবর এলো যেতে হবে পাশের ঘরে……
পাশের ঘরে যেতেই সালাম দিলাম। কয়েকজন একসঙ্গে সালামের উত্তর নিলেন। মনে হলো কোনো মিলাদ-মাহফিলের গুঞ্জন উঠলো একসাথেই। বসলাম।

মেয়ের খালু: বাবা, তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?
আমি: আলহামদুলিল্লাহ
মেয়ের খালু: তোমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
আমি: হবু বধূকে নিয়ে কোনো এক নির্জন দ্বীপে একটা বাসা বেঁধে থাকবো আর কবিতা লিখবো।
মেয়ের খালু: বউকে আয় না করে খাওয়াবে কিভাবে?
আমি: সেই চিন্তা যেনো না করতে হয় এজন্য বেশ টাকা গুছিয়েই যাবো। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
মেয়ের খালু কি ভাবলো জানি না, তবে যা-ই ভাবুক, আমি মনের কথাগুলোই বলতে সবসময় ভালবাসি। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। এবার আসলো মেয়ের বাবার কথা–

মেয়ের বাবা: বাবা, আমার মেয়ের মধ্যে সমস্যা রয়েছে, যা তুমি জানো। তারপরেও তোমার কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে বলো আমাকে।
আমি: আমার কোনো দাবি নেই। আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকলে আমি শুধু আপনার মেয়েকেই গ্রহণ করতে চাই। আমার অন্য কিছুতে লোভ নেই।
মেয়ের বাবা: চোখ মুছে বললেন, “আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।”

এর মধ্যে বিয়ের তারিখ ধার্য্য হলো। সঙ্গত কারণেই একটি ঘরোয়া পরিবেশে বিয়েটাও সেরে ফেলেছিলাম। বিয়ের রাতেই বউ এর কাছ থেকে একটা অমূল্য উপহার হিসাবে চিঠি পেলাম।

প্রিয় বর,

আস সালামুআলাইকুম। আপনি আমার জীবনকে ধন্য করেছেন। আমার এই জীবনে কোনো আশা ছিলো না। আমি কখনও ভাবি নি যে কেউই এই অপায়াকে আবার গ্রহণ করবে। গত ২ বছরে কেঁদে কেঁদে আমার সময় পার হয়েছে। মনে হয়েছে, কাঁদলেই মনে হয় ভেতরের পাথরগুলো সরে যায়। কান্না বন্ধ করলে আবার পাথর এর নিচে আটকা পড়ে যায়। জীবনটা অসহ্য হয়ে উঠেছিলো। আমি জানি না আর বাকশক্তি ফিরে পাবো কিনা তবুও মরে হয়তো শান্তি পাবো যে; কেউ আমার এই পাপী জীবনে একটু আলো ছড়াতে এসেছে। আমি হয়তো আপনাকে বেশি কিছু দিতে পারবো না, তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেনো সামান্য কষ্ট না দিই। আমার কোনো ভুল হলে ক্ষমা করে দিবেন। আমাকে শুধু আপনার ছায়াতলে জায়গা দিয়েন, তাতেই খুশি।

ইতি
আপনার স্ত্রী কুসুম কলি

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo