ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ

গ্রিক পুরাণের বীর যোদ্ধা হারকিউলিস নাকি সিংহের সঙ্গে লড়াই করে জিতেছিলেন। সিংহ বিশালদেহী হিংস্র প্রাণী। তার সঙ্গে লড়াই করা বড় সহজ কথা নয়। কিন্তু অতি ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করা যেন তার চেয়েও কঠিন। এদের হারানো খুব মুশকিল। তবে মুশকিল আসান করে দিয়েছিলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, পেনিসিলিন আবিষ্কারের মাধ্যমে, সেই ১৯২৮ সালেই। ৯০ বছর পর আবারও ব্যাকটেরিয়া–আতঙ্ক চারদিকে। এবার আর রক্ষে নেই। ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে মানুষের একমাত্র অস্ত্র অ্যান্টিবায়োটিক মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পথে। নতুন অস্ত্রের সন্ধানে নামতে হবে। দুষ্ট ব্যাকটেরিয়াকে বধ করতে হবে। নইলে মানবজাতির বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী। মানুষকে ফিরে যেতে হবে প্রাক-অ্যান্টিবায়োটিক যুগে। যেখানে ডাক্তার-পথ্য কোনো কাজে আসবে না। শুরু হবে কবিরাজদের রমরমা ব্যবসা। ঝাড়ফুঁক ছাড়া আর যে কোনো উপায় নেই!

অ্যান্টিবায়োটিক আসলে কীভাবে কাজ করে? সোজা কথায়, অ্যান্টিবায়োটিক মানুষ আর ব্যাকটেরিয়ার পার্থক্য বুঝতে পারে। যেমন ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীর আর মানুষের কোষপ্রাচীরের যে পার্থক্য আছে, তা অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ধরতে পারে। তাই সে শুধু ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরকে ধ্বংস করে দেয়, কোষপ্রাচীর ছাড়া ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। আবার ব্যাকটেরিয়ার প্রোটিন তৈরির ধরন, ডিএনএ রেপ্লিকেশনের পদ্ধতি মানুষের থেকে আলাদা। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো সহজে শুধু ব্যাকটেরিয়ার কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন তৈরিকে বন্ধ করে দেয় বা ডিএনএ তৈরি বন্ধ করে দেয়। তাহলে ব্যাকটেরিয়াগুলো আর বাঁচতে পারে না।

তবে নিজেকে বাঁচানোর খুব চমকপ্রদ পদ্ধতি জানা আছে এদের। অতি ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াও প্রকৃতিতে টিকে থাকতে চায়। প্রকৃতিও এ ক্ষেত্রে এদের সহায়। অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সব অস্ত্রই প্রকৃতি এদের দিয়েছে। ব্যাকটেরিয়ার প্রধান হাতিয়ার এদের দ্রুতগতির বংশবৃদ্ধি। মুহূর্তেই এরা নিজেদের দুই ভাগ করে কোটি কোটি কপি তৈরি করে ফেলতে পারে। প্রতিটি কপি তৈরির সময় ডিএনএকেও কপি করতে হয়। এ রকম লাখো-কোটি ডিএনএ কপি করার সময় এদের অনেক ভুল হয়।

এই ভুলটাই এদের বাঁচিয়ে দেয়। এই ভুলটাই আসলে ডিএনএ মিউটেশন বা পরিব্যক্তি। আর মিউটেশন এদের টিকে থাকার চাবিকাঠি। এই মিউটেশন এমনভাবে হয়, যাতে এরা অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে। যেমন ধরা যাক, কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরকে আক্রমণ করল। এই অ্যান্টিবায়োটিক থেকে বাঁচার জন্য ব্যাকটেরিয়া নিজের কোষপ্রাচীরের গঠন এমনভাবে বদলে ফেলে যে অ্যান্টিবায়োটিক একে আর চিনতেই পারে না! নিজেকে বাঁচাতে এমন ছদ্মবেশ ধারণ করে সে।

তবে কেউ কেউ ছদ্মবেশে ধোঁকা দেওয়ার থেকে সম্মুখযুদ্ধ পছন্দ করে বেশি! যেমন ব্যাকটেরিয়া এমন সব উপাদান তৈরি করে, যা অ্যান্টিবায়োটিকদের মেরে ফেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিনের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া ‘বিটা ল্যাকটামেজ’ এনজাইম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তাই পেনিসিলিন আর কাজই করতে পারে না।

সবচেয়ে ভয়ংকর কথা হলো, ব্যাকটেরিয়া খুব সাহায্যপ্রবণ। নিজের প্রাণ বাঁচিয়েই শুধু বসে থাকে না, অন্যকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। কীভাবে? কোনো ব্যাকটেরিয়া যখন অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের বিরুদ্ধে নিজেদের ডিএনএতে পরিবর্তন আনে, তখন সেই পরিবর্তিত ডিএনএ উপাদান সে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াকে দান করে। এতে আগে যেসব ব্যাকটেরিয়ার ওই নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে দেখাই হয়নি, এরাও আগেভাগে জেনে যায় কীভাবে ওই অ্যান্টিবায়োটিককে মোকাবিলা করতে হবে।

ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের মধ্যে খুব কাছাকাছি এসে অথবা কোনো সেতু তৈরি করে এই ডিএনএ আদান-প্রদান করে। এই শক্তিশালী তথ্য আদান-প্রদানের কারণে খুব নিরীহ ব্যাকটেরিয়াও আমাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর। কারণ তখন কোনো ওষুধই আর কাজ করবে না।

প্রশ্ন আসতে পারে, ব্যাকটেরিয়াজনিত কোনো রোগে মানুষ যদি অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে, তাহলে তো সব ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। কীভাবে ব্যাকটেরিয়া সুযোগ পাচ্ছে নিজেদের পরিবর্তন করে অন্যদের মাঝে ডিএনএ ছড়িয়ে দেওয়ার? সুযোগটা আসলে আমরাই করে দিচ্ছি।

অ্যান্টিবায়োটিকের যাচ্ছেতাই ব্যবহার ব্যাকটেরিয়াকে করে দিচ্ছে শক্তিশালী। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই প্রবণতা আরও ব্যাপক। এখানে চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়াই ডিসপেনসারিতে অবাধে বিক্রি হয় অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট। এ যেন বাড়ির পাশের দোকান থেকে চকলেট কিনে খাওয়ার মতো! রোগী হয়তো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জ্বরে ভুগছে। রোগী অথবা ওষুধের দোকানে বসা বিক্রেতা নিজেই চিকিত্সকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন কয়েক পাতা অ্যান্টিবায়োটিক। যে ওষুধ শুধু ব্যাকটেরিয়াকে মারতে পারে, সে যে ভাইরাসের গায়ে এতটুকু আঁচড়ও দিতে পারে না, তা আমাদের বিশেষজ্ঞ রোগী বা দোকানদারের জানা নেই! ভাইরাস জ্বর সাধারণত নিজে থেকেই অল্প সময়ের মধ্যেই সেরে যায়। এখানে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো অবদানই নেই। তবে রোগীর শরীরের ভেতরে যে ব্যাকটেরিয়াগুলো ছিল, এদের জানা হয়ে যায় কীভাবে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

এরপর এরা শরীর থেকে কোনোভাবে বের হতে পারলেই হলো। আশপাশের সবাইকে জানিয়ে দেবে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে এদের রণকৌশল। কিছু রোগী আবার চিকিত্সকের কথামতো রোগ নির্ণয় করে হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে অ্যান্টিবায়োটিক খায়। তবে অসচেতনতার কারণে হয়তো দু-এক দিন ওষুধ খেতেই ভুলে যায়! আবার সুস্থ হয়ে গেছি ভেবে পুরো ওষুধের পুরো কোর্স কমপ্লিট না করেই ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়। এতে তার শরীরের সব ব্যাকটেরিয়া পুরোপুরি ধ্বংস হয় না। যারা রয়ে যায়, এরা শিখে যায় কীভাবে বাঁচতে হবে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে। হাসপাতালের পয়োনিষ্কাশন ড্রেনে পাওয়া যায় এ রকম লাখ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া পরিবার। এরপর যখন ওই রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া অন্য কাউকে আক্রান্ত করবে, তখন আর রক্ষা নেই। কারণ পুরোনো ওষুধ আর তখন কাজ করবে না।

অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করলে আমাদের কী কী অসুবিধা হতে পারে দেখে নেওয়া যাক। যক্ষ্মা বা মেনিনজাইটিসের মতো নিরাময়যোগ্য রোগেই মানুষের মৃত্যু হবে। প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে যে লাখ লাখ অপারেশন হয়, তার সব বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ অপারেশনের সময় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হওয়া খুবই স্বাভাবিক, যা এখন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে প্রতিরোধ করা হয়। যেহেতু অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না, তাই সব ধরনের সার্জারি বন্ধ। এমনকি প্রসূতি মায়ের সিজারিয়ান ডেলিভারিও করা যাবে না!

স্বাভাবিক চলাফেরায়ও খুব সাবধান থাকতে হবে। কারণ হঠাৎ খুব অল্প পরিমাণ অংশ কেটে গিয়ে যদি সংক্রমণ হয়, তাহলে ওই সামান্য কাটাই তার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট! বোঝাই যাচ্ছে, পুরো পৃথিবীর মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়।

এর থেকে বাঁচার উপায় কী? নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার? বিজ্ঞানীরা ল্যাবে ঘাম ঝরিয়ে ফেলছেন এর জন্য। তবে একটা নতুন অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কঠিন ধাপ পেরিয়ে বাজারে আসতে লেগে যেতে পারে ১৫ বছর! তত দিনে অনেক মানুষ মারা যাবে। এখন এমনও দেখা যাচ্ছে যে সবচেয়ে নতুন যে অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে এসেছে, সেও ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না!

মৃত্যুর ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। ঘণ্টার আওয়াজ আরও জোরদার হচ্ছে। এবার আমাদের সচেতন হওয়ার পালা। চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা যাবে না। পূর্ণ ডোজ সেবন করতে হবে, মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আইন করে ডিসপেনসারিতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ধ্বংস হয়ে যাব আমরা। আর তা হবে নিজেদের ওপরই পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মতো।

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo