এইচএসসিতে শূন্য পাস, তবু চলে এসব কলেজ

দেশে এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেননি ৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। তার একটি ঢাকার এশিয়ান আইডিয়াল কলেজ।

রাজধানীর উত্তর মুগদায় অবস্থিত এশিয়ান আইডিয়াল কলেজে গতকাল বুধবার গিয়ে দেখা গেল, প্রতিষ্ঠানটির সামনে ডিজিটাল ব্যানারে ভর্তির বিজ্ঞাপনে লেখা, সব শ্রেণির মতো এইচএসসিতেও তাদের পাসের হার শতভাগ। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এবার কলেজটি থেকে একজন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। তিনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি।

সরেজমিন আরও দেখা গেল, প্রতিষ্ঠানটির ভবনে তিনটি সাইনবোর্ড রয়েছে। একটিতে নাম এশিয়ান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। আরেকটিতে নাম এশিয়ান আইডিয়াল স্কুল। আরও এক জায়গায় লেখা এশিয়ান আইডিয়াল কলেজ। অবশ্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তালিকায় প্রতিষ্ঠানের নাম এশিয়ান আইডিয়াল কলেজ।

একটি ভবনে চলা প্রতিষ্ঠানটিতে প্লে-গ্রুপ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ নেসার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে এখন প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। তাঁর দাবি, গতবার তাঁদের কলেজ থেকে নয়জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সবাই পাস করেছিলেন। কিন্তু মাঝে একাডেমিক স্বীকৃতিসংক্রান্ত অসুবিধার কারণে এ বছর পরীক্ষার্থী ছিলেন একজন। কিন্তু সমস্যাটি কেটে গেছে।

এবার যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করতে পারেননি, সেসব প্রতিষ্ঠানের ৯টিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেগুলোতে শিক্ষার্থী একেবারেই কম। শিক্ষকসংকট রয়েছে। পড়াশোনা তেমন একটা হয় না। কলেজগুলো চলছে মূলত নামকাওয়াস্তে।

শূন্য পাস ৪২ কলেজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে, ১৬টি। এ ছাড়া যশোরে ৭টি, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন ৫টি, রাজশাহীতে ৪টি, ময়মনসিংহে ৪টি, চট্টগ্রামে ৩টি এবং কুমিল্লায় ১টি কলেজ থেকে কেউ পাস করতে পারেননি। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন দুটি মাদ্রাসা রয়েছে শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের তালিকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ১৫টিতে পরীক্ষার্থী ছিলেন একজন করে। কেবল একটিতে সর্বোচ্চ ২১ জন, আরেকটিতে ১৯ জন পরীক্ষার্থী ছিলেন। বাকিগুলোতে কয়েকজন করে পরীক্ষার্থী ছিলেন।

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে গত রোববার। এবার ৯ হাজার ১৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছিলেন। গত বছর শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫০। তার আগের বছর ছিল পাঁচটি।

সরেজমিনে যা দেখা গেল

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন শূন্য পাস করা পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি নর্দার্ন কলেজ, বাংলাদেশ। এই কলেজ থেকে একজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন, পাস করেননি।

রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের মূল সড়কের পাশে একটি বহুতল ভবনের দোতলায় কলেজটির অবস্থান। গত মঙ্গলবার বন্ধ দেখা যায়। গতকাল দুপুরের পর আবারও কলেজটিতে গিয়ে দোতলায় উঠে দেখা যায়, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। দরজা বন্ধ। কেউ সেখানে নেই। পরে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মী জানান, অবরোধের কারণে কেউ আসেননি।

পরে মুঠোফোনে কলেজটির অধ্যক্ষ মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, কলেজটি আগে মোহাম্মদপুরের আসাদগেট এলাকায় ছিল। ২০১৭ সালে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতে আসে। কিন্তু করোনার সময়ে শিক্ষার্থী কমে যায়।

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাইকান্দি ইউনিয়নের ডা. দেলোয়ার হোসেন মেমোরিয়াল কলেজ থেকে পাঁচজন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করতে পারেননি। গতকাল সকাল ১০টায় কলেজটিতে গিয়ে দেখা যায়, দোতলা ভবনের দরজায় তালা দেওয়া। দরজা-জানালায় ধুলাবালুর স্তর।

কলেজটির অধ্যক্ষ উত্তম বিশ্বাস মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে। তিনি সেখানেই থাকেন। মাঝে মাঝে কলেজে আসেন। কলেজ থেকে কোনো বেতন-ভাতা দেওয়া হয় না। তিনি বলেন, শিক্ষা বোর্ড ২০২১ সাল থেকে কলেজটিতে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। চলতি বছর যে পাঁচজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরা অনিয়মিত।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মোড়ল হাট জনতা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে পাঁচজন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করেননি। জেলার আরও দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একই অবস্থা—সদর উপজেলার কদমরসুলহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও পীরগঞ্জ উপজেলার পীরগঞ্জ আদর্শ কলেজ।

পীরগঞ্জ আদর্শ কলেজে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, শ্রেণিকক্ষে ঝুলছে তালা। চারপাশে ময়লা-আবর্জনা।

অধ্যক্ষ মহসিনুল হকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর স্ত্রী ও কলেজের শিক্ষক রুখসানা পারভীন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কলেজটি ২৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। তবে এখনো এমপিওভুক্ত (বেতনবাবদ সরকারি অনুদান) হয়নি। করোনাকালে শিক্ষার্থীদের অনেকেই ঝরে পড়ে।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ইসলামিয়া মহিলা কলেজ থেকেও কেউ পাস করেননি। পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনজন। কলেজের অধ্যক্ষ মর্জিনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চাৎপদ এলাকার কলেজে যেসব ছাত্রী ভর্তি হয়, তাদের অনেকের কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। ফলে তারা ঠিকমতো পড়াশোনার সুযোগ পায় না।

নড়াইল সদর উপজেলার গোবরা মহিলা কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় দুজন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। পরীক্ষার ফলাফলে দুজনই অকৃতকার্য হয়েছেন।

স্বীকৃতি বাতিলের চিন্তা

শিক্ষা বোর্ড ও কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি রয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কোনোরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে এমপিওভুক্তির আশায়। এসব প্রতিষ্ঠানে কেমন পড়াশোনা হয়, তার কোনো কার্যকর তদারকি করে না শিক্ষা বিভাগ।

এবার শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষকে ডেকে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তাঁদের ভাবনায় আছে পরবর্তী সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন শিক্ষার্থী থাকবে, সেসব প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বাতিল করা হবে। শিক্ষার্থী থাকলে তাদের আশপাশের কোনো কলেজের মাধ্যমে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo