ক্রিকেট-ফুটবলের ‘বিয়ে’—জন্ম নতুন খেলার

ব্যাটসম্যান আছেন কিন্তু তাঁর হাতে কোনো ব্যাট নেই। নাম তাঁর লেগসম্যান। হেলমেট-টেলমেটের বালাই নেই। ওসবকে বুঝি ‘দুর্বলচিত্তে’র মানুষের প্রয়োজন ভাবেন তাঁরা! অবশ্য এখানে হেলমেটের দরকারও পড়ে না!

এখানে ভুল পায়ে বল লাগলেই আউট। বলটা স্টাম্পে ছিল কি না, লাইন কোথায় ছিল—এসব কিছুই বিবেচনায় নেবেন না আম্পায়ার। বোলারও আছেন, কিন্তু যে বল দিয়ে তিনি বল করেন, তা ক্রিকেটের বলের চেয়ে কয়েকগুণ বড়। একটা প্রমাণ সাইজের ফুটবল!

লেগ ক্রিকেটের দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগতম।

ভারত ক্রিকেটপাগল দেশ। এ কথা জানে সবাই। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাও কম নয়। এ দুটি খেলার মিশেলে নতুন খেলা ‘লেগ ক্রিকেট’-এর জন্ম ভারতে। ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল নাগাদ মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদে সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের মাঠে এ খেলার চর্চা হয়।

তখন এ মাঠ ছাড়াও ভারতের নানা জায়গায় নিজস্ব নিয়মে খেলায় অংশ নিতেন সবাই। সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে স্থানীয় তরুণ মেহুল সোরাথিয়া খেলাটি পরিচয় করে দিয়েছিলেন। ২০১০ সালে দিল্লির শারীরিক শিক্ষক যোগিন্দর প্রসাদ ভার্মা লেগ ক্রিকেট নিয়ে নানা গবেষণার পর খেলাটির আনুষ্ঠানিক নিয়মবালী তৈরি করেন। লেগ ক্রিকেটের বিস্তার এখন ভারত ছাপিয়ে পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, ফ্লোরিডা, ঘানা ও বাংলাদেশের কিছু অংশেও ছড়িয়ে পড়েছে।

খেলাটির জনপ্রিয়তা ভারতে বাড়ছে ধীরে ধীরে। এর মধ্যে বেশ কিছু রাজ্য লেগ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেছে ভারত লেগ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএলসিএ) অধীনে। সংস্থাটির মতে, আরও পাঁচটি দেশ অফিশিয়ালি এ খেলায় অংশ নেয়। ভারত লেগ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক চন্দন রায় ‘হিন্দুস্তান টাইমস’কে বলেন, ‘খেলাটির জন্ম ভারতে। কর্ণাটকে এ খেলার শুরু হলেও ধীরে ধীরে দেশের অন্যান্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ে।’

ক্রিকেটে যেমন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি, লেগ ক্রিকেটেও তেমনি আইএলসিসি—তাদের অধীনে ২০১৩ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশ নিয়েছিল ভারত ও নেপাল। তারপর থেকে বয়সভিত্তিক নানা পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলেছে ভারত, নেপাল ও ভুটান।

খেলাটি দেখলে মনে হবে ক্রিকেট ও ফুটবলের মিশেলে নতুন এক সংস্করণ। রসিকজন ভাবতে পারেন, ক্রিকেট ও ফুটবলের বিয়ের ফলে জন্ম নেওয়া নতুন ‘অতিথি’। চন্দন রায়ের ভাষায় বর্ণনা দেওয়া যাক। এটা ক্রিকেটের চেয়েও সহজ। পাওয়ার প্লে, ফিল্ডিংয়ে ৩০ গজের বাধ্যবাধকতা, এলবিডব্লিউ এমনকি ব্যাট, প্যাড কিংবা গ্লাভসের বালাই নেই। লেগ ক্রিকেট খেলতে দরকার শুধু ফুটবল, স্টাম্প ও ২২ জন খেলোয়াড়।

৮০ থেকে ১২০ ফুট ব্যাসার্ধের মাঠে লেগ ক্রিকেট খেলা হয়। পিচে প্রস্থে ৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ ফুট লম্বা হয়। শুধু পিচ নয়, বাউন্ডারি সীমানাও ক্রিকেটের চেয়ে ছোট। তবে পিচ ও সীমানা নির্ভর করে খেলোয়াড়দের বয়সের ওপর।

খেলার মৌলিক নিয়মগুলো নেওয়া হয়েছে ক্রিকেট থেকে। ফুটবলটাই এখানে বল। সেটি ‘আন্ডারআর্ম’ অ্যাকশনে গড়িয়ে অন্য প্রান্তে লেগসম্যানের উদ্দেশে বোলিং করবেন বোলার। বল ‘বাউন্স’ করলে নো-বল। ব্যাটসম্যানকে তাঁর শক্তিশালী পা-কে ‘ব্যাট’ বানাবেন, কোন পায়ে খেলবেন সেটা আগে জানাতে হবে। বল অন্য পায়ে লাগলেই আউট। ফিল্ডিং পজিশনে বাধ্যবাধকতা নেই, ৯জন ফিল্ডারও পাশাপাশি রাখতে পারেন।

টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি, টি১০, হান্ড্রেড বল...এত আনুষ্ঠানিক বা পরীক্ষামূলক সংস্করণ এখানে নেই। লেগ ক্রিকেটের সংস্করণ একটাই—টি১০। ২০১৬ সালে ভারত লেগ ক্রিকেট দলের দায়িত্ব পাওয়া চন্দন জানালেন, অনুশীলনে ফিল্ডিংয়ের কসরতগুলো নেওয়া হয়েছে ক্রিকেট থেকে। ফিটনেস এবং লাথি মারার কৌশল ফুটবল থেকে নেওয়া। এ খেলার জন্য শারীরিকভাবে ফিট থাকার বিকল্প নেই। ক্রিকেটের মতো লেগ ক্রিকেটেও একজন বোলার সুইং কিংবা স্পিন করতে পারবেন।

করোনাভাইরাসের কারণে ভারতে লেগ ক্রিকেটে কিছু বড় টুর্নামেন্ট বাতিল হয়েছে। পিছিয়েছে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। আইপিএলের আদলে লেগ ক্রিকেটেও ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থায় খেলার স্বপ্ন দেখেন চন্দন, ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ খেলাটা আমাদের স্বপ্ন। আইপিএলের মতোই সেখানে খেলোয়াড় বেচা-কেনা করবে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো।’

তবে লেগ ক্রিকেট জনপ্রিয়তা পেলেও ভারতের ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এখনো খেলাটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। খেলোয়াড়দের কোনো ম্যাচ ফি নেই। এমনকি যাতায়াত খরচও দিতে হয় নিজের ঝুলি থেকে। চন্দন তাই অপেক্ষায়, ‘আমরা সরকারের স্বীকৃতি পাওয়ার অপেক্ষায়। এতে জীবনটা সহজ হবে। মেয়েরাও এ খেলায় উঠে আসছে। আশা করি খেলাটা দ্রুতই স্বীকৃতি পাবে।’

Ref: Prothom Alo, ২৯ আগস্ট ২০২০, ১১:২৩

 

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo