পুলিশ দেখলে মাস্ক পরি

ঢাকার বনশ্রী-মোহাম্মদপুর রুটে চলাচলকারী তরঙ্গ প্লাস পরিবহনের একটি বাসের হেলপার আব্দুল কুদ্দুস রিপনের মাস্কটি ছিল হাতে ধরা; তার মধ্যেই শুক্রবার দুপুরে যাত্রী ডাকছিলেন তিনি।

 

মাস্ক হাতে কেন- প্রশ্ন করা হলে তার উত্তর- “সরকার নিয়ম করে দিয়েছে, তাই সাথে মাস্ক রাখছি। পুলিশ দেখলে মাস্ক পরি, আর না হয় মাঝে মাঝে খুলে রেখে দিই।”

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর সর্বপ্রধান অস্ত্র হিসেবে মাস্কের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সেটা যে কোনো ব্যক্তির নিজেরই কেবল নয়, তার পরিবারের সুরক্ষার জন্যও। সেজন্য দেশে করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুতেই গত বছর ঘরের বাইরে মাস্ক বাধ্যতমূলক করে সরকার।

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় গত এপ্রিলে ফের লকডাউন দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যেই জেলার অভ্যন্তরে গণপরিবহন চালুর যে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে শর্ত দেওয়া ছিল স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

কিন্তু গণপরিবহন চালুর পরদিন শুক্রবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে স্বাস্থ্যবিধি মানার চিত্র কমই দেখা গেছে।

ছুটির দিন বলে যাত্রী সংখ্যা কম ছিল, ফলে এক আসন ফাঁকা রেখে বসার বিধি মানতে দেখা গেছে। কিন্তু বাসে যাত্রী উঠানোর সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

চালক কিংবা হেলপার অধিকাংশের মুখে মাস্ক ছিল না। কারও ছিল পকেটে, কারও হাতে, কারও বা ঝুলছিল থুতনির নিচে। একই উদাসীনতা যাত্রীদের বেলায়ও দেখা গেছে।

উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে পোস্তগোলা রুটে চলাচল করা রাইদা পরিবহনের অন্তত অর্ধশতাধিক বাস কয়েক ঘণ্টায় পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তাদের কোনো গাড়িতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা হয় না। থুতনির নিচে মাস্ক ঝুলিয়ে হেলপাররা হাঁকডাক করে যাত্রীদের ধরে বাসে উঠাচ্ছেন।

কয়েকটি বাসের ভেতর গিয়ে দেখা যায়, কিছু কিছু যাত্রীও মাস্ক খুলে গাড়িতে বসেছেন।

টঙ্গী থেকে যাত্রাবাড়ি রুটে চলাচলরত তুরাগ পরিবহনের অধিকাংশ বাসের ভেতরেই ছিল নোংরা। টানা ২২ দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও এসব বাস পরিচ্ছন্ন করা হয়নি। বাসগুলোর ভেতরের বসার আসনগুলোর কাপড় ছেঁড়া, কোনো কোনো বাসের আসন ভাঙাও।

তুরাগ পরিবহনের একটি বাসের হেলপারকে যাত্রাবাড়িতে দেখা যায়, অন্যান্য গাড়ির সাথে প্রতিযোগিতা করে যাত্রীদের হাঁকডাক দিয়ে তুলতে। সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে এবং কোনো মাস্ক না পরেই যাত্রী তোলায় ব্যস্ত ছিলেন ওই পরিবহনকর্মী।

স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে হেলপার খোকন মিয়া বলেন, “এখন যাত্রী কম, গ্যাদারিং কম, যে কারণে মাস্ক পরিনি। মাস্ক একটা ছিল, হাত থেকে রাস্তায় পড়ে গেছে, সামনে গিয়ে আরেকটা কিনব।”

এই বাসেও বেশ কয়েকজন যাত্রীকে মাস্ক খুলে বসে থাকতে দেখা গেছে।

স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়ে যাত্রীদের একজনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গাড়িতে তো লোকজন কম, যে কারণে মাস্ক একটু খুলে বসেছি। সারাদিন মুখে মাস্ক পরে থাকলে অস্বস্তি লাগে।”

আব্দুল্লাহপুর থেকে সদরঘাট রুটে চলাচল করা ভিক্টর পরিবহনের বাসেও একই চিত্র দেখা যায়।

এই পরিবহনের একটি বাসের চালক মো. ফারুক মাস্ক থুতনির নিচে রেখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেক গরম পড়েছে, সারাক্ষণ মুখে মাস্ক দিয়ে রাখলে ঘেমে গিয়ে শ্বাস নেওয়া কষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে মাঝে মাঝে মাস্ক খুলে রাখি।”

উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ রুটে চলাচল করা আকাশ পরিবহনের একটি বাসের হেলপারের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু তা কোনো যাত্রীকে ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

ওই হেলপারের কাছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদেরকে মালিকপক্ষ থেকে বলে দেওয়া আছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাতে রাখতে হবে। আমরা তো রাখি, কিন্তু যাত্রীরাই ব্যবহার করতে চায় না।”

মিরপুর-১২ থেকে যাত্রাবাড়ি রুটে চলাচল করা শিকড় পরিবহনের একটি বাসের চালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, “প্রায় এক মাস ধরে গাড়ি চালানো হয়নি। কিছু আন্দোলনের পর এখন যেহেতু সরকার আমাদেরকে গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়েছে তাই সরকারের নিয়ম-কানুন মেনে চলা উচিত। আমরা চেষ্টা করি যতটুকু পারা যায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালানোর।”

তবে অধিকাংশ গাড়িতে যে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, তা স্বীকার করেন তিনি। আর তাতে সংক্রমণ বাড়ার বিপদের চেয়ে বেশি ভয় তিনি পাচ্ছেন, যদি আবার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

আশরাফুল বলেন, “ড্রাইভার-হেলপাররা যদি নিয়ম ভঙ্গ করে, তাহলে আবার করোনাভাইরাস বেড়ে গেলে লকডাউন আসতে পারে, তখন সরকার আবার গাড়ি বন্ধ করে দিতে পারে। এই জন্য সবাইকে নিয়ম মেনে গাড়ি চালানো উচিৎ।”

একইভাবে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে গাড়ি চালাতে দেখা যায় রাজধানীর ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার থেকে মোহাম্মদপুর রুটের গাড়ি স্বাধীন পরিবহন, গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া রুটের গ্রীণ অনাবিল পরিবহনকে।

অন্যদিকে মিরপুর থেকে খিলগাঁও রুটের নূরে মক্কা পরিবহন এবং খিলগাঁও থেকে মোহাম্মদপুর রুটে চলাচল করা মিডলাইন পরিবহনের বাসগুলোর চালক, হেলপার বা অধিকাংশ যাত্রীদের যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী আহ্বান জানিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দাবি ছিল যানবাহন খুলে দেওয়ার। সরকার কিছু শর্ত সাপেক্ষে পারমিশন দিয়েছে। আমরা সব সময় বলে আসছি, সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন গাড়ি চালানো হয়। কেউ যদি তা ভঙ্গ করে তাহলে ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এটা কাম্য হতে পারে না। আমাদের আহ্বান হলো- সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।”

যাত্রীদের নিয়ে কাজ করা যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীও একইভাবে বলেন, “কিছু কিছু যাত্রী আছেন, তারা কখনও কখনও বুঝতে চান না যে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করলে জীবনের ঝুঁকি আছে। আমরা সকল যাত্রী-চালক ও হেলপারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালাতে আহ্বান জানাই।”

গত ৫ এপ্রিল থেকে দেশে চলমান লকডাউনের বিধিনিষেধ জারি হয়, ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয় ‘কঠোর’ লকডাউন। তখন থেকেই সড়ক, নৌ ও রেলপথে যাত্রী পরিবহন বন্ধ হয়েছিল।

সম্প্রতি দোকান-পাট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালু হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে গণপরিবহন চালুর দাবিতে গত রোববার সারা দেশে বিক্ষোভ করেন সড়ক পরিবহন শ্রমিকরা।

এরপর গত বৃহস্পতিবার থেকে ‘শর্ত সাপেক্ষে’ গণপরিবহন চালু করে সরকার। শর্ত হল, পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং প্রতি ট্রিপে গাড়ি জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

সুত্র- bdnews24

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo