সবকিছু খোলা রেখে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী কতটা যৌক্তিক

অফিস-আদালত, কলকারখানাসহ সবকিছু খোলা রেখে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের কথা বলা হয়েছে। যাতায়াতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সবকিছু খোলা রেখে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক-এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে গণপরিবহন চলাচল নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া ট্রেনের ওপর চাপ বাড়বে। লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং টেম্পো জাতীয় ছোট যানে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হবে। পাশাপাশি যাত্রীদের ওপর বাড়তি ভাড়ার চাপ পড়বে।

করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গত সোমবার রাতে ১১ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এর একটি দফায় বলা হয়েছে, বাস, ট্রেন ও লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী বহন করা যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকারিতার সুনির্দিষ্ট তারিখসহ নির্দেশনা জারি করবে। সব ধরনের যানের চালক ও সহকারীদের অবশ্যই কোভিড টিকাধারী হিসেবে সনদ থাকতে হবে।ইতিমধ্যে রেল কর্তৃপক্ষ অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ট্রেন চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। শনিবার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) আজ বুধবার বনানীতে সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকে বসেছে। কবে থেকে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে বাস চলবে এবং ভাড়া কত হবে-এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআইডব্লিউটিএ) লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের বিষয়ে আজকে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে।

বিআরটিএ ও পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কিছু বাস্তব সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন-এ দফায় কোনো অফিস-আদালত ও কলকারখানা বন্ধ না করেই গণপরিবহন অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে। এর ফলে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরে আসলে যাত্রী আগের মতোই থাকবে। কিন্তু গণপরিবহনে ধারণ ক্ষমতা অর্ধেক কমে যাবে। বর্তমানে অফিস শুরু এবং ছুটির সময় বাসগুলোতে ঠাসাঠাসি করে যাত্রী পরিবহন করা হয়। তাহলে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে এবং দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন না করলে বাকি যাত্রী কোথায় যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর।

২০২০ করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় শুরুতে গণপরিবহন একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়। জুলাইয়ের দিকে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে গণপরিবহন চালু করা হয়। সে সময় দোকান-পাট, বিপণি বিতান খোলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ ছিল। করোনার আতঙ্কের কারণে মানুষের যাতায়াতও ছিল তুলনামূলক কম। ফলে গণপরিবহনে অর্ধেক আসন নিয়ে চলতে বড় কোনো সমস্যা হয়নি। ২০২১ সালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে গণপরিবহন কিছুদিন বন্ধ রাখার পর পুনরায় অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে চালানো শুরু হয়। এ দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বিধিনিষেধের কড়াকড়ি কিছুটা কম ছিল। মানুষের ভয়-আতঙ্কও কিছুটা কেটে যায়। অফিস-আদালতে যাতায়াতও বেশি হয়। ফলে গণপরিবহনে চাপ পড়ে যায়। তখন পরিবহন শ্রমিকেরা বাড়তি যাত্রী বহন করেছেন। কোথাও কোথাও যাত্রীরা জোর করে বাসে উঠেছেন। এমনও দেখা গেছে, যাত্রীদের চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে পুলিশও বাসে যাত্রীদের উঠিয়ে দিয়েছেন।

আগের দুই দফায় অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নিয়মের পাশাপাশি বাসে যাত্রী ভাড়াও ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা এর চেয়েও বাড়িয়ে আদায় করেন। ঢাকার ফার্মগেট-নিউমার্কেট, ফার্মগেট-মোহাম্মদপুর কিংবা ফার্মগেট-ধানমন্ডি; মতিঝিল-খিলগাঁওসহ বিভিন্ন পথে লেগুনা-টেম্পোতে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায়। ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয় এসব ছোট যানেও। পাশাপাশি বেড়ে যায় রিকশা ভাড়াও।
এবার এখনো ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা আসেনি। গত নভেম্বরে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর বাস-মিনিবাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার শর্তে বাস নামালে ভাড়া অন্তত ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে।

আর বাসের ভাড়া বৃদ্ধি পেলে ঢাকার আশপাশের যেসব জেলায় কমিউটার ট্রেন চলাচল করে, সেগুলোতে চাপ পড়ে যাবে। তখন অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ট্রেন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মতিঝিল থেকে নারায়ণগঞ্জে বাসের ভাড়া কম-বেশি ৫০ টাকা। ৫০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি পেলে এ পথের ভাড়া হয়ে যাবে ৭৫ টাকা। অন্যদিকে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে ট্রেনের ভাড়া ২০ টাকা। ফলে বাসের অনেক যাত্রী ট্রেনে যেতে ভিড় করবে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে দিনে ৩০ টির বেশি ট্রেন চলাচল করে। এরপরও অফিস শুরু ও ছুটির সময় গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করেন। বাস ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা এলে যাত্রীর চাপ আরও বেড়ে যাবে। তখন রেল কর্তৃপক্ষ ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে। নতুবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক নিশ্চিত করার বিষয়গুলো কথার কথায় পরিণত হবে।

একইভাবে মতিঝিল থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত বাস-মিনিবাসের ভাড়া ৯০ টাকা। ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে ভাড়া গিয়ে ঠেকবে ১৩৫ টাকা। এই পথে চলাচলকারী কমিউটার ট্রেনের ভাড়া ২০ টাকা। রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, কমলপুর স্টেশন থেকে টিকিট দেখে দেখে যাত্রী প্রবেশ করানোর সুযোগ আছে। কিন্তু তেজগাঁও বা পথের অন্য কোনো স্টেশন থেকে বেশি যাত্রী উঠে গেলে কে ঠেকাবে? এ ছাড়া জয়দেবপুর থেকে যাত্রী বোঝাই করে উঠলে রেলের লোকজন ঠেকাতে পারবে?

ঢাকাসহ বড় শহরে রাইড শেয়ারিং সেবা চালু আছে। রাইড শেয়ারিং সেবায় কত যানবাহন ও মোটরসাইকেল নিয়োজিত আছে এর প্রকৃত হিসাব বিআরটিএর কাছে নেই। সংস্থাটি শুধু রাইড শেয়ারিং এর লাইসেন্স প্রাপ্ত যানের হিসেব রাখে। এ সংখ্যা ২৬ হাজারের মতো। এর ৮০ শতাংশ মোটরসাইকেল। তবে প্রকৃতপক্ষে গাড়ি ও মোটরসাইকেল এর কয়েকগুণ বেশি চলে।

অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার বিধান এ রাইড শেয়ারিং সেবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না, এটাও পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে মোটরসাইকেলে চালকের পেছনে একজন যাত্রী পরিবহন করা হয়। সে ক্ষেত্রে তো মোটরসাইকেল বন্ধই রাখতে হবে। আর বন্ধ না রাখলে মোটরসাইকেলের ওপরও যাত্রীর চাপ বাড়বে।

করোনা মহামারির পর থেকে দূরপাল্লার পথে মানুষের যাতায়াত কিছুটা কমেছে। তবে গত মাস ছয়েক ধরে পর্যটন এলাকাগুলোর পথে মানুষের ঢল নেমেছে। ফলে এসব পথের দূরপাল্লার বাস আসন পূর্ণ করেই চলাচল করেছে। সরকার পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করেনি। ফলে যাত্রীর চাপ খুব বেশি কমার কথা নয়। তাহলে এসব পথে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার নিয়ম কতটা মানা হবে-এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এ ছাড়া নভেম্বরে এমনিতেই ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। আরও বাড়লে মানুষ কি তা বহন করতে পারবে? পর্যটনকেন্দ্র ছাড়া অন্য জেলা শহরে হয়তো অর্ধেক যাত্রীর নিয়ম কিছুটা মানা যাবে। কিন্তু বড় সমস্যা হবে ঢাকার মতো বড় শহরে।

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo