শিক্ষা হোক পরিকল্পিত সুশিক্ষা

গত বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১২ লাখের কিছু বেশি এবং এ বছর দেশে মোট পরীক্ষার্থী পৌনে ১৪ লাখ। এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজারের কিছু বেশি শিক্ষার্থী এবং গতবারের পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। এবার গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ এবং গত বছর পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫।

দুটো বিষয় লক্ষণীয়

১. গত বছর ১২ লাখের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন এবং এবার পৌনে ১৪ লাখের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজারের কিছু বেশি।

২. এবার গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ এবং গত বছর পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫।

আমার ভাবনা, কী কারণে পাসের এবং সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫-এর সংখ্যা এ বছর কম।

শুনেছি, দেশে বিশ্বমানের শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক মানের মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও সেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তিতে আগ্রহ বাড়ছে অভিভাবকদেরও।

যদি কয়েক লাখ টাকা প্রতিবছর এবং কম করে হলেও ধরি ১০ বছর লেখাপড়ার পর যে বেতনের চাকরি পাবে, সেটা বাংলাদেশে কত, দুর্নীতি ছাড়া? এত বড় এক বিনিয়োগ, অথচ কী রিটার্ন বা কীভাবে রিটার্ন হবে, ভেবেছেন কি অভিভাবকেরা?

আমি মনে করি, ‘শিক্ষা হোক পরিকল্পিত সুশিক্ষা’—বাংলার মাটি উর্বর পলি দ্বারা গঠিত। তাই এ দেশমাতার মৃত্তিকাগর্ভে যা ফলানো হয়, তা-ই ফলে। কখনোবা পাটের সোনালি আঁশে কৃষকের মন হাসে। কখনোবা কিষানির নয়ন আগামী স্বপ্ন বুনে সবুজ ধানের উচ্ছ্বাসে ভাসে!

বুদ্ধিমান কিষান-কিষানি ঋতুকাল বুঝে, সময় বুঝে, উপযোগী আবহাওয়া ও ভবিষ্যৎ বাজার ভেবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কোনো মৌসুমে মাটিতে কী চাষ করা হবে? এ জমিনে যেমন ধান, গম, শস্য উৎপাদন সম্ভব সহজেই, ঠিক তেমনি ফোটে গোলাপ, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনাও। চাইলে রোপণ করা যায় আম, লিচু, আনারসসহ আরও কত-কী! ভূমি খননে সহজেই হয় জলাশয়, যে জলে মৎস্য চাষও হতে পারে, বাঙালি রবে তার চিরায়ত ঐতিহ্যে, যেন সেই মাছে-ভাতে। কিন্তু শ্রমসাধন না হলে, আগামীকে নিয়ে না ভাবলে, ঋতুর সময় অজানা থাকলে কী হবে? এই পলি মাটিতে আগাছা জন্মাবে।

৬ হাজার ৭৪৩ কিলোমিটার দূরে পাশ্চাত্য দেশ সুইডেন থেকে নাড়ির টানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রূপক অর্থেই সহজ করে গুছিয়ে কথাগুলো লিখছি। বাংলাদেশের উর্বর ভূমির মতোই এ দেশের সব শিশু-কিশোর জন্মগতভাবেই মেধাবী।

মেধাবী তারা ধ্যানে, জ্ঞানে, মনে। কিন্তু দিকশূন্য পথে এ প্রজন্মের লক্ষ্য অনিশ্চিত পথচলা আগামীর বাংলাদেশের জন্য এক অশনিসংকেত। দেশের লাখো ছেলেমেয়ে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে চলেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দিনে দিনে টিউশন ফি যেভাবে বাড়িয়ে চলেছে, তেমনি যেন উচ্চশিক্ষিত হওয়ার আশায় ছেলেমেয়েদের ভিড় শিক্ষালয়ে বাড়ছে। এই উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা যেমন জানে না তাদের এই শিক্ষা গ্রহণ ও পরবর্তী কর্মক্ষেত্র কোথায়, তেমনি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ভাবনাহীন, দায়মুক্ত শিক্ষার্থীর কর্মক্ষেত্র নিয়ে!

এসব উচ্চতর ডিগ্রিধারীর ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র কতটা আছে, কোথায় আছে? তাই এই মুহূর্তে প্রয়োজন সময় উপযোগী শিক্ষাদান ও যথাযথ কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা। আগামীর দেশ নির্মাণে ভবিষ্যৎ বিশ্ববাজারের অবস্থা না জেনেই তারা বড় হচ্ছে! সঠিক পরিকল্পনা আর সনাতন শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক যেন মূর্খ কৃষকের প্রতিরূপ, এ কারণেই ফলন ফলছে না ভালো বরং সৃষ্টি হচ্ছে আগাছা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি সহজেই উতরিয়ে চলেছে সবাই।

সার্টিফিকেট অর্জন করেও চাকরি পাচ্ছে না ছাত্রছাত্রীরা। অন্তত ৭০ ভাগ শিক্ষিত তরুণ তরুণীর তাই হতাশা, আর বেকারত্বের অভিশাপ গিলে খাচ্ছে তারা। কিন্তু কী আছে উপায়? এই দশা ও অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে হলে শুধু শিক্ষা বা শিক্ষিত হওয়াই বড় কথা নয়; সুশিক্ষায় জ্বলে উৎপাদনমুখী হওয়াটাই হোক চূড়ান্ত কথা। বেকারত্বকে বিদায় জানিয়ে হোক দেশের উন্নয়ন, উৎকর্ষসাধনই হোক আগামীর শিক্ষাব্যবস্থা। পৃথিবী যেমন ঘূর্ণমান, তেমনি যুগে যুগে শিক্ষার মূল্য ও বিশ্ববাজার বদলে যাচ্ছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময় ও প্রয়োজনের সীমারেখায়। অগ্রণী চিন্তায় আমার পৃথিবী উদ্ভাসিত হবে আমার জ্ঞানের আলোকে! এই শিক্ষা গ্রহণ হবে আমার উপার্জন।

দেশ এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ উন্নয়নের সড়কে ঊর্ধ্বমুখী এক দেশ। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ও সময়ের স্রোতে এ দেশের সব সেক্টরেই লেগেছে আজ ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। কিন্তু আমাদের ধ্যানে-জ্ঞানে এ ছোঁয়া আজও লাগেনি! লেগেছে কি?

আমরা যেন ঠিক খেটে খাওয়া বোকা কৃষকের মতোই সময় ও শ্রম পণ্ড করে চলেছি। সে কৃষক এখন আর পলি দ্বারা বেষ্টিত এ ভূমিভাগ থেকে ফুল-ফসল পায় না! তৃণভূমিভরা আগাছা তার হতাশার মতো এক দুঃস্বপ্ন। ঠিক এমন অবস্থা আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায়! যে দেশে উন্নত মেধা আছে, পর্যাপ্ত মেধাবী আছে, কিন্তু এখনো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাপনার কাঠামো এতটাই দুর্বল যে নীতিনির্ধারকেরা জানেন না কোন সময় কতজন শিক্ষার্থীকে কোন ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত করতে হবে! দেখুন, সাত বছরের স্কুলজীবন সবে শুরু করা বিপুলকে সারা দিনই তার বাবাও বলে পড়, পড়, পড়! মাও বলতে থাকে পড় পড়!

বিপুল মা-বাবার একমাত্র ধন। বাবা স্কুলের শিক্ষকতা করেন, আর মা গৃহিণী। বিপুল হয়তো বোঝে না, কেন সবাই এত পড়তে বলে? কিন্তু মা-বাবা জানেন, ছা-পোষা জীবনের একমাত্র যে আলোকিত পথ তার বিপুলের জন্য খোলা, তার নামই শিক্ষা। দেশের এখনো শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বসবাস করছে, আর এমনও কোটি বিপুলকে আলোকিত পথের পথিক হতে উৎসাহ দিচ্ছেন শিক্ষক, অভিভাবকসহ সকলেই। কোটি বিপুল যখন এ পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হবে, তখন প্রাণের বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে সক্ষমতা অর্জন করবে। তাই আমি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও আগামীর শিক্ষাব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি আধুনিক ও উপযোগী দিকনির্দেশনা প্রদান করতেই চাই।

আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটি পরিকল্পিত সমন্বয়, যা সাধনেই হবে প্রকৃত শিক্ষা তথা কার্যকর শিক্ষার প্রসার। দেখুন, আগামী ১০ বছর পর আমাদের দেশে কী পরিমাণ চিকিৎসক লাগবে? আর বর্তমান শিক্ষাধীন অবস্থায় কী পরিমাণ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে?

দেশের শীর্ষ শিক্ষাবিদ বা গবেষকদেরও এই উত্তর অজানা! ঠিক তেমনি উর্বর ভূমির মতো মেধাবী তরুণসমাজকে নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা থাকতে হবে। আগামী ১০ বছর পর বাংলাদেশ তথা বিশ্বজুড়ে যদি প্রকৌশলী বেশি দরকার হয়, তবে দেশের জোগান ও চাহিদার প্রাচুর্য থাকলে আমরা দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে প্রকৌশলী বিশ্বে রপ্তানি করব।

আগামী ১০ বছর পর দেশে কী পরিমাণ কৃষক লাগবে ফসল ফলাতে, সেই পরিমাণ দক্ষ কৃষক আমরা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাদান করেই তৈরি করতে পারি। অর্থাৎ দেশ ও জাতির উন্নয়নে এবং সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিক এ পরিবর্তনই সোনার বাংলা বিনির্মাণে সোপান হবে, যেখানে সবকিছুর সঙ্গেই থাকবে আজ ও আগামীকে নিয়েই, শিক্ষা খাত থাকবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অধীন। যে শিক্ষাব্যবস্থায় মেধাবীদের মেধা অনুসারে গড়ে তোলা হবে, আর নিশ্চিত হবে দেশের মেধার মূল্যায়ন ও মেধাবীদের যোগ্য ব্যবহার।

দেশকে ডিজিটাল করার অর্থ এ নয় যে সবাই ঘরে বসে টিকটক তৈরি করবে, রূপকথার বাণী রসিকতায় পরিপূর্ণ করে টক শো বা ইউটিউবে ছাড়বে আর জাতি অত্যন্ত মনোযোগসহ শ্রবণ করবে, সেগুলো নিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডাখানায় শেয়ার করবে এবং অট্টহাসির খোরাক জোগাবে।

মানবজাতির সৃষ্টি হয়েছে চলমান গতিতে থাকার জন্য, ডিজিটাল হয়ে থাকার জন্য নয়। ঘরে বসে যেমন কৃষিকাজ করা সম্ভব নয়, ঘরে বসে ডিজিটাল হয়ে টিকটক, ইউটিউব বা টক শো করে দেশের পরিকাঠামো বা রাজনীতির পরিবর্তন করা যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি আদর্শ ও যুগোপযোগী সুশিক্ষাও পাওয়া সম্ভব নয়। জাগো বাংলাদেশ, জাগো।

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo