শিল্পীর চোখে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারের সেই প্রতিবাদ সমাবেশ, ৪ মে ১৮৮৬ছবি: সংগৃহীত
প্রকাশ: ০১ মে ২০২৪
আমেরিকা–ইউরোপজুড়ে পয়লা মে একসময় ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন’ বলেই পরিচিত ছিল। উত্তর গোলার্ধের মানুষেরা মে দিবসের প্রথম দিনটিতে বসন্তবরণ উৎসবে মেতে উঠত। রিক্ত–শূন্য শীতের অবসান ঘুচিয়ে তা ছিল উষ্ণতার উৎসব। বিশেষত, শ্রমজীবী মানুষদের কাছে বসন্তের আগমন ছিল বিশেষ কিছু। কিন্তু বছরের পর বছর অবর্ণনীয় শ্রমশোষণে নিষ্পেষিত শ্রমজীবী মানুষ ফুল খেলবার দিনটিতেই পথে নেমেছিল, ফুঁসে উঠেছিল সম্মিলিতভাবে।
ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
কল্পনা করুন, একজন শ্রমিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টানা ১৬ ঘণ্টা কাজ করছেন। বিরতিহীন। পারিশ্রমিকও খুবই নগণ্য। আজ থেকে ১২৭ বছর আগে আমেরিকান সমাজে এ–ই ছিল নিয়ম। এই নির্মম জুলুম আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে আমেরিকার শ্রমিকেরা ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’ প্রতিষ্ঠা করেন।
আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে শিকাগোতে শ্রমিকদের বিক্ষোভছবি: সংগৃহীত
১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর ফেডারেশন অব লেবারের চতুর্থ সম্মেলনে গৃহীত হয় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সর্বাত্মক ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে। শিকাগো শহরে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম আর ৮ ঘণ্টা বিনোদনের দাবিতে সর্বাত্মক ধর্মঘট ডাকে কারখানার শ্রমিকেরা। সমূহ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে, বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষেরা যূথবদ্ধ হয়ে পথে নামেন।
সেদিন তাঁরা চাইছিলেন, সরকার সব কারখানায় শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা বেঁধে দিক আট ঘণ্টা। এর অতিরিক্ত সময় বা শ্রম দিলে শ্রমিকদের আলাদা পারিশ্রমিক দিতে হবে। বইপত্তর ঘেঁটে জানা যায়, ওই দিন ধর্মঘটে প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিক পথে নামেন। ধর্মঘট প্রতিহত করতে নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে শ্রমিকদের কয়েকজন মারা যান। অসংখ্য শ্রমিক হতাহত হন। এই ঘটনার সূত্র ধরে ৩ মে ম্যাককর্মিক হার্ভাস্টার কারখানায় শ্রমিকেরা রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পুলিশ সেখানেও গুলি চালায়। তাতে প্রাণ হারান ছয় নিরীহ শ্রমিক।
নিউইয়র্ক শহরে মে দিবসের মিছিল, ১৯০৯ছবি: সংগৃহীত
এর পরদিন ৪ মে পুলিশি হত্যার প্রতিবাদে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে আয়োজিত হয় এক বিশাল প্রতিবাদ সভা। পুলিশ এই সভায়ও গুলি চালায়। শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয় হে মার্কেট স্কয়ার। সভা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় চার শ্রমিকনেতাকে। বিচারে তাঁদের ফাঁসির আদেশ জারি হয়।
সেদিন তাঁরা চাইছিলেন, সরকার সব কারখানায় শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা বেঁধে দিক আট ঘণ্টা। এর অতিরিক্ত সময় বা শ্রম দিলে শ্রমিকদের আলাদা পারিশ্রমিক দিতে হবে। বইপত্তর ঘেঁটে জানা যায়, ওই দিন ধর্মঘটে প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিক পথে নামেন। ধর্মঘট প্রতিহত করতে নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে শ্রমিকদের কয়েকজন মারা যান। অসংখ্য শ্রমিক হতাহত হন। এই ঘটনার সূত্র ধরে ৩ মে ম্যাককর্মিক হার্ভাস্টার কারখানায় শ্রমিকেরা রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পুলিশ সেখানেও গুলি চালায়। তাতে প্রাণ হারান ছয় নিরীহ শ্রমিক।
পথে এবার নামো সাথি, পথেই হবে এ পথ চেনা
শিকাগো শহরের রক্তাক্ত ইতিহাস সারা বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে আলোড়ন তোলে। আমেরিকার শ্রমিকেরা বৃহত্তর আন্দোলনের পথে পা বাড়ান। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে ওঠে। অধিকার আদায়ে শ্রমিকেরা কারখানা ছেড়ে নামেন পথে। শ্রমজীবী মানুষেরা রক্তে রঞ্জিত পথেই অধিকার আদায় করে ছাড়েন। এ ঘটনার দুই বছর পর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে পালনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ১৮৯১ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। পরে ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী মে মাসের প্রথম দিন মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
গ্রিসের এথেন্সে মে দিবসের মিছিল, ১৯৭৭ছবি: সংগৃহীত
এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বের প্রায় সব শ্রমিক সংগঠন পয়লা মে বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশের শ্রমিকেরা মে মাসের ১ তারিখ সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানান। বিভিন্ন দেশে মে দিবস সরকারিভাবে ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী দিনটির তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে।
রক্তাক্ত পথ বেয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি। পরবর্তী সময়ে মে মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে শ্রমিক দিবস মে দিবস নামে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে।