আমার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ- আবুল কালাম আজাদ

মুক্তিযুদ্ধের সময় অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে কংশ ছিলো খরস্রোতা নদী। ভরা বর্ষায় নদীর পানি তরতর করে হামলে পড়তো উজান থেকে ভাটিতে। এই স্রোতের সাথে ঝুঝে,সাঁতার কেটে সাহস বেড়েছে,বয়স বেড়েছে ! শিশু থেকে কিশোর এবং কিশোর থেকে যুবক হয়েছি।
তখন ভরা বর্ষা। সেই রাতে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম সুরেলা আওয়াজ। এমন রাতে নিঃসীম ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার কথা গ্রামের মানুষের। কিন্তু তা হয়নি।
গোলাগুলির প্রচন্ড আওয়াজে মৃত্যুর আতঙ্কে বিনিদ্র রজনী কেটেছে মোহনগঞ্জের কাছাকাছি আশেপাশের গ্রামের মানুষের। সারারাত ধরে ভারী ও হালকা অস্ত্রের মুহূর্মুহু গগনবিদারী শব্দ শুনতে শুনতে ভোর হয়েছে।
সকালে পূর্বাকাশ ফর্সা হতে না হতেই আমাদের বাড়ীর সামনে কয়েকজন পাকসেনা গিয়ে হাজির,সাথে আদম আলী রাজাকার।
আদম আলীর বাড়ী আলোকদিয়া নাকি নামাপাড়া ঠিক মনে পড়ছে না। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে সে ছিলো সিঁদেল চোর। এলাকায় সে আদম আলী চোরা বলে কথিত ছিলো।
যাহোক,বাড়ীর সামনে গিয়েই আনফর আলী নামে একজন'কে আটক করে পাকসেনারা। এই আনফর আলীর বাড়ী সিলেটের কোন এক জায়গায়। সে আমাদের জায়গায় ঘর করে সংসার পেতেছিলো ।
তার একটি মহাজনী নৌকা ছিলো আয়ের উৎস্য।
আনফর আলীকে ধরে গতরাতে গোলাগুলি সম্পর্কে জানতে চাইলো। সে বোকার মতো উত্তর দিলো, আমি কিছু জানি না,বাড়ীর মালিক জানে। বাড়ীর মালিক মানে আমার বাবা।
আদম আলীকে দিয়ে আব্বাকে ডেকে আনলো। তাকেও একই প্রশ্ন "মুক্তি কিদার হ্যায় ?"
আব্বা বললেন আমি কিছু জানি না। কোন মুক্তি আমি দেখিনি। রাতে শুধু গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, ঝুট বাত বলি না।
আনফর আলীকে বেশ মারধোর করলো আমাদের চোখের সামনেই। আব্বা সব সময় লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পড়তেন ও মাথায় টুপি রাখতেন,দাঁড়ি ছিলো। সে জন্যই হয়তো উনাকে কোন টর্চার করে নাই। দুজনকেই ধরে নিয়ে গেলো মোহনগঞ্জ থানায় পাকবাহিনীর মূল ক্যাম্পে।
বাড়ীতে পড়লো কান্নার রোল। সে সময় পাকসেনারা যাকে ধরে নিয়ে যায়, সে আর জীবিত ফিরে আসে না।

(আব্বা ও আনফর আলী বেঁচে ফিরে এলেন।
আগের লেখায় যা বলছিলাম--আব্বা আর আনফর আলীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমাদের বাড়ীতে কান্নার রোল উঠেছে,সাথে চলছে তাদের ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা।
ভগ্নীপতি আলোকদিয়ার সোনামিয়া চৌধুরী বাড়ী ছেড়ে পরিবার সহ বাসাউরা বেঙ্গালার দিকে কোথাও গিয়ে উঠেছেন আরও আগেই। তিনি আলোকদিয়ার রাজাকার দুদু মিয়ার কাছে খবর পাঠালেন যে কোন মূল্যে তার শ্বশুরকে ছাড়িয়ে আনার জন্য।
লেদা'র বাপ মোবারক মিয়া পাকবাহিনীর ক্যাম্প থেকে খবর নিয়ে এলেন আব্বা ভালো আছে। তখন স্টেশন এবং পাটগুদামের কুলিদের পাকবাহিনী কিছু বলতো না,কারণ কুলিরা পাকসেনাদের গুলির বাক্স ও অন্যান্য মালামাল পরিবহন করতে কাজে লাগতো।
আমি লেদা'কে (হাসেম) নিয়ে কয়েকবার থানা-বাড়ী ছুটাছুটি করলাম,কিন্তু থানার সামনের সড়ক থেকে উঁকিঝুঁকি মারা ছাড়া কোন খবরই আনতে পারলাম না।
সন্ধ্যার আগে আগে আব্বা এবং আনফর আলী বাড়ীতে ফিরে এলেন। সবাই স্বস্তির হাঁফ ছাড়লো।
নানাবিধ তদবির এবং খোঁজখবর করে আব্বার নামে খারাপ কোন রিপোর্ট না পেয়ে ছেড়ে দিলো,কিন্তু আনফর আলীকে ছাড়বে না বললো। আব্বা পাকসেনাদের বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে,আনফর নিরিহ গরীব মানুষ,সে মুক্তিযোদ্ধা না,বা মুক্তিযুদ্ধের সাথে তার কোনরূপ সংশ্লিষ্টতা নাই।
ঘটনা-চিত্রের সাথে যদি সময় মিলাই,তবে সময়টা হতে পারে মার্চ-এপ্রিল। পাকবাহিনী তখনো মোহনগঞ্জে পৌঁছায় নাই।
মোহনগঞ্জে গরুহাট্টা বলতে কংশ নদীর তীরবর্তী যে স্থানটিকে সবাই চিনতো,সেখানে প্রতি বুধবারে গরুর হাট বসতো। এখন বসে কি না জানি না। তবে সেটা যে এখন শুঁটকি মহাল হয়েছে,তা নিজের চোখেই দেখে এসেছি।
আমাদের গ্রামে একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। নাম মজিবুর রহমান ওরফে চন্দু মিয়া। লিকলিকে শারিরিক গড়নের লম্বাচওড়া তেজিয়ান মানুষ। তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) বা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করেছিলেন '৭১এর আগে। চন্দু মিয়া গরুহাট্টায় বাঁশের লাঠি,ডামি বন্দুক দিয়ে যুবকদের যুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন। এইসব দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। তাই প্রতিদিন বিকালবেলা সেখানে গিয়ে ট্রেনিং দেখতাম।
এই গরুহাট্টা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহনগঞ্জের অন্যতম বধ্যভুমি। সন্ধ্যা নামার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গরুহাট্টা থেকে গুলির শব্দ, মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসতো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আঁধার নেমে আসার সাথে সাথে আমার মা গরুহাট্টার দিকে কান পেতে থাকতেন। গুলির আওয়াজ গুনতেন। এক সময় হাহাকার করে উঠতেন। বলতেন, আজ এতজন মায়ের বুক খালি হয়েছে। পাকিসেনাদের অভিসম্পাত দিতেন,আল্লাহর কাছে বিচার চাইতেন।
আমার মায়ের ধারণা ছিলো,একটি গুলির আওয়াজ মানে একজন মানুষের মৃত্যু। তাই গুলির আওয়াজ গুনে কতজন মানুষ'কে আজ হত্যা করা হয়েছে,সেই হিসাব মেলাতেন।

(যে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন ধর্মপাশার মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন তালুকদার)
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি যে সব কথা লিখছি তার সবই আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এইসব ঘটনা আমার শিশু মনে গভীর দাগ কেটেছিলো বলেই হয়তো অনেকগুলো ঘটনার বেশী অংশ আমার মনে আছে,চোখে ভাসে। অবশ্য বড় হয়ে আমার মায়ের সাথে বিভিন্ন সময় আলাপ করে সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করেছি এবং রিফ্রেস করেছি
সেদিন রাতে বৃষ্টি হয়েছে। সকালে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে মেঘলা আকাশ। সেকালে গ্রামের প্রায় সকল বাড়ীতে বাঁশের তৈরী টয়লেট ছিলো,যাকে বলা হতো টাট্টি। সকালে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে টাট্টিতে গিয়ে দেখি কেউ একজন অলরেডি ভিতরে আছে। চাপ বেশী থাকায় আমি দৌড়ে সড়কের দিকে এলাম।
বলে রাখছি যে, আমার বয়সী গ্রামের শিশুরা এই কাজটা প্রায়শই সড়কের ধারে, ক্ষেতের আলে বসে সেরে ফেলতো। তো সড়কে এসে প্যান্ট খুলে মাত্র বসেছি, অমনি পাশে থেকে ঝুপঝুপ আওয়াজ এলো। ভিজা মাটিতে দুর্বা ঘাসে লাফ দিয়ে পড়লে যে ধরণের আওয়াজ হয়,ঠিক ওরকম আওয়াজ।
তাকিয়ে দেখি সড়কের সাথে লাগানো একটি মহাজনী নৌকা থেকে পাকসেনারা লাফিয়ে নামছে। কিসের প্রকৃতির ডাক। বাড়ির দিকে দিলাম দৌড়। এসে আম্মা আব্বাকে ঘটনা বললাম। আমার চাচাতো বোন সালেহা ছিলো বিবাহযোগ্যা। আব্বা আম্মাকে বললেন, তুমি সালেহারে নিয়া পিছন দিয়া আলোকদিয়ার দিকে ভাগো।
বাড়ীর পেছনের জঙ্গল দিয়ে আমরা পশ্চিমে আলোকদিয়ার দিকে যেতে থাকলাম। যেতেযেতে পেছনে তাকিয়ে দেখি সড়ক দিয়ে লাইন বেঁধে অনেক পাকসেনা অস্ত্র উঁচিয়ে সিংধা'র দিকে এগুচ্ছে। বেশকিছু সময় পেরিয়ে গেলো। পাকসেনাদের পেছনের অংশটুকুও আমাদের দৃষ্টি-সীমানার বাইরে নুরুল্লারচর, সিংধার আড়ালে বিলীন হয়ে গেলো। তৎপরেই শুরু হলো গোলাগুলি। সে কি যে প্রচন্ড গোলাগুলি। ভারী অস্ত্রের,হালকা অস্ত্রের আওয়াজে কয়েক মাইল এলাকা প্রকম্পিত, রণক্ষেত্র। 
বাকীটা বড়দের কাছে শোনা কথা,এবার সেটা বলছি। সিংধা বাজার থেকে ধর্মপাশা যেতে মাঝে একটা বন্দ বা ফসলী জমির খোলা মাঠ ছিলো। আমাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে যে সব মিলিটারী ধর্মপাশা যাচ্ছিল, তারা সামাইকোনার কাছাকাছি যেতেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ঠিক একই সাথে আর একদল পাকসেনা মোহনগঞ্জ থেকেও সরাসরি ধর্মপাশা যাচ্ছিলো।
ফলে সামাইকোনা-ধর্মপাশা এলাকায় অবস্থান করা মুক্তিযোদ্ধা-দলটি মূলতঃ দু'দল পাকসেনার মাঝে পড়ে যায়। আমরা কয়েকঘন্টা ধরে যুদ্ধের আওয়াজ শুনি। বিকালের দিকে যুদ্ধ থামলে খবর পাই যে, পাকসেনারা ধর্মপাশা দখলে নিয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন,নাম শামসুদ্দিন তালুকদার।
এই যুদ্ধে পাকসেনাদের একজন জুনিয়র অফিসারও মারা যায়। বিকালে নৌকায় করে তার লাশ যখন মোহনগঞ্জ নিয়ে আসা হয়, সেই দৃশ্য বাড়ীর সামনে নদীর তীরে দাড়িয়ে দেখেছি। আবছা হলেও এখনো মনে পড়ে, কয়েকজন পাকসেনা সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি মৃতদেহ নৌকার পাটাতনে শুইয়ে মোহনগঞ্জে নিয়ে আসছে !

(আলোকদিয়া গ্রামে ধরা পড়লো এক পাকসেনা)
পাকবাহিনীর একজন সৈনিক প্রায় প্রায়ই এপাড়ে অর্থাৎ আলোকদিয়া ধনপুর আসতো। ছাগল,মোরগ ডাব পেঁপে এসব নিয়ে যেতো। তার সঙ্গী ছিলো আদম আলী রাজাকার। পাকসৈনিকটির নাম লাল মোহাম্মদ ছিলো মনে হয়। তার চেহারার মধ্যে শুধু গোঁফ'টা এখনো আমার চোখে ভাসে। মোটা গোঁফের আগা'র অংশ দুইগালে গোল করে পাকানো ছিলো।
রোজার মাস। একদিন সে আদম আলীকে নিয়ে আমাদের বাড়ীতে এলো। হুকুম দিলো মোরগ আর ডাব দিতে। কয়েকটি মোরগ ধরে দেয়া হলো। গাছে পাকা পেঁপে ছিলো, দেয়া হলো। কয়েক ছড়ি ডাবও দেয়া হলো। আমার বাবা ইফতার করার জন্য একটি ডাব চাইলে সে দেয়নি--এটা আমার খুব ভালোমত মনে আছে।
এই পাকসেনার ঘনঘন আসা-যাওয়া যে মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ্য রাখছিলো,সেই খবর কারো জানা ছিলো না। একদিন লাল মোহাম্মাদ আলোকদিয়া গ্রামে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ফাঁদে ফেলে ধরে নিয়ে যায়, সাথে আদম আলী রাজাকারকেও ধরে। শুনেছিলাম, এই খবর না কি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও প্রচার হয়েছিলো।
এ কথা জানাজানি হওয়ার সাথে সাথে আব্বা বাড়ীর সবাইকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ী ছাড়তে তৈরী হতে বলেন। সেদিন সন্ধ্যায়ই আমরা বাড়ী ছেড়ে আশিয়ল গ্রামে শাহনেওয়াজ তালুকদারের বাড়ীতে গিয়ে উঠি। তিনি আমাদের পূর্ব পরিচিত ছিলেন। মোহনগঞ্জ বাজারে আসতে-যেতে তিনি আমাদের বাড়ীতে বসে তামাক-টামাক খেতেন,আব্বা আম্মার সাথে গল্পগুজব করতেন। আমি বহুবার দেখেছি।
শাহনেওয়াজ তালুকদারের বড় ছেলে ফজলু ভাই মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) সদস্য ছিলেন, পরে মোহনগঞ্জ কলেজে চাকরি করেছেন। ছোট ছেলে নজরুল ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আমার সহকর্মী ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ এবং '৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরবর্তি সময়ে শাহনেওয়াজ তালুকদারের পরিবারের উপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে।
সেই রাতটা শাহনেওয়াজ তালুকদারের বাড়ীতে কাটিয়ে সকালে আমরা নানার বাড়ী ধর্মপাশা থানার কান্দাপাড়া চলে যাই। হাওর এলাকা হওয়ায় সেখানে পাকবাহিনীর আনাগোনা ছিলো না। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত কান্দাপাড়ায় আমরা ভালোই ছিলাম। মোহনগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমরা সেখানেই অবস্থান করি।
আমরা যেদিন বাড়ী ছাড়ি তার পরদিনই মোহনগঞ্জের পাকবাহিনী আমাদের বাড়ী সহ আলোকদিয়া ধনপুরের বেশকিছু বাড়ী পুড়িয়ে দেয়। তারমধ্যে আমার ভগ্নিপতি সোনামিয়া চৌধুরীর বাড়ীও আছে।

কান্দাপাড়া'র সময়টায় দিনকাল ভালো কাটলেও এবং নিরাপদ বোধ করলেও এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দুর্ভানার বাইরে কেউ ছিলো না।
সময়টা সম্ভবত ডিসেম্বর মাস। হাওরের পানি শুকিয়ে কান্দা বা চট্টন ভেসে উঠছে। সেই কান্দায় বোরো ধানের বীজতলায় সবুজ ধানের চাড়ার অঙ্কুরোদগম হচ্ছে। কোন কোন বীজতলায় ধীরে ধীরে সবুজ ধান-গাছ বেড়ে উঠছে।
একদিন হাজি টুকাইতে গেছি বাড়ীর পাশের কান্দায়। হঠাৎ ভীম গর্জনে মাথার উপর দিয়ে দুই তিনটি বিমান উড়ে পূব থেকে পশ্চিমে গেলো। এতো নীচে দিয়ে গেলো যে, মনে হলো আমাদের মাথায় লেগে যাবে। আমরা কয়েকজন একই বয়সী শিশু হাজি কুড়ানো বাদ দিয়ে ভয়ে বাড়ীর দিকে দিলাম দৌড়।
গ্রামের বড়-ছোট সবাই ভয়ে তটস্থ। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। বিকালের দিকে অনেক উপর দিয়ে আরও বিমান পশ্চিম থেকে পূবে উড়ে গেলো। পরে জেনেছিলাম এগুলো মিত্রবাহিনী অর্থাৎ ভারতীয় বিমান। বিমান যখন অপারেশনে যায়,নীচ দিয়ে যায় আর বম্বিং করে ফেরার সময় উপর দিয়ে ফেরে।
রাত গভীর। সবাই ঘুমে। হঠাৎ বাইরে থেকে কারা যেনো ডাকছে ! আমরা খালাম্মার ঘরে থাকতাম। এ ঘরে কয়জন শিশু আর আমার মা এবং খালা। ডাক শুনে আম্মা কুপি বাতি জ্বালিয়ে দরজা খুলে বারান্দায় এলেন। পিছে পিছে খালাম্মা এবং আমিও এলাম। উঠানে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। কুপির আলোতে দেখতে পাচ্ছি তাদের সবার কাঁধে অস্ত্র ঝুলানো। কারো পড়নে প্যান্ট,কারো লুঙ্গি জ্যাকেট, কারো মাথায় ক্যাপ, কারো মাথা খালি।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বললেন,ভয় পাবেন না,আমরা মুক্তিযোদ্ধা। ঘরের পুরুষ লোককে ডাক দেন। আগেই বলেছি এই ঘরে দুজন মহিলা আর আমরা মামাতো খালাতো কয় ভাইবোন ছাড়া পুরুষ কেউ ছিলো না। আম্মা পাশের দুই ঘর থেকে আমার মামা রুস্তম আলী ও আক্কেব আলীকে ডেকে আনলেন।
মুক্তিযোদ্ধারা যা বললেন,তা মোটামুটি নিম্নরূপ--
হাওরে (বাড়ীর সামনেই হাওর) মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি নৌকা এসেছে,সকালে আরও নৌকা আসবে। প্রায় হাজার খানেক মুক্তিযোদ্ধার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সকালে খাওয়াতে হবে এবং সাথে পিঠা বানিয়ে দিতে হবে। আগামীকাল থেকে বড় যুদ্ধ হবে। যুদ্ধের ময়দানে কয়দিন থাকতে হয় ঠিক নাই,তাই পিঠা সাথে রাখতে হবে।
এই কথাবার্তা চলার সময় পাশের কয়েক ঘর থেকেও পুরুষ মহিলারা এগিয়ে এলেন। সারা কান্দাপাড়ায় সাজসাজ রব পড়ে গেলো। কুপি,হ্যারিকেন,হ্যাজাক লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে গেলো পুরো গ্রাম।
মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের আয়োজন শুরু হয়ে গেলো মহা ধুমধামে। এই এলাকার শক্তিশালী গ্রাম হলো কান্দাপাড়া। পাশের রাধানগর,কেশবপুরেও খবর গেলো। সেখানেও একই অবস্থা।
চোখে না দেখলে আমার এই বর্ণনাকে মনে হবে কোন সিনেমার কল্পিত দৃশ্য।
সকালের আকাশ ফর্সা হতে না হতেই মুক্তিযোদ্ধা দেখার জন্য আশপাশের গ্রামের ছেলেবুড়ো, মহিলা পুরুষের ভীড় জমলো হাওর পাড়ে।
বড়বড় নৌকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নামছে। নামানো হচ্ছে নানান ধরণের অস্ত্র। সেগুলো সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো হচ্ছে কান্দার মাটিতে দূর্বাঘাসের উপর।
এদিকে সড়কের দুইপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের আয়োজন চলছে। গ্রামে সবার ঘরে যতো খাবারের থালা-বাটি,মাটির-সানকি ছিলো সব এনে সাজানো হচ্ছে সারিসারি। ভাতের বড়ছোট ডেক,সালুনের পাতিলা-কড়াই থেকে উঠছে গরম ধোঁয়া।
নানান বয়সী মুক্তিযোদ্ধা। গোঁফ উঠে নাই,চেহারায় শিশুসুলভ অভিব্যক্তি এমন মুক্তিযোদ্ধাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে মানুষ। কেউ কাঁদছে,কেউ দোয়া করছে---সে এক দারুণ অভূতপূর্ব দৃশ্য ! চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
এবার রওনা দেয়ার পালা। মুক্তিযোদ্ধারা এক লাইন করে ধাবিত হচ্ছেন ধর্মপাশার দিকে। সাথে ভার বাঁশের দুদিকে দুটি করে খলুইভর্তি নানাজাতের ছোট ছোট পিঠা,যা এক কামড়ে খাওয়া যায়,সেই পিঠার খলুই নিয়ে চলেছেন গ্রামের কয়েকজন সাহসী মানুষ।
কান্দাপাড়ার পরেই হলো মহদিপুর। মহদিপুরে একটি হিজল-মুক্তা'র(মুত্তা,এই গাছের বেত দিয়ে শীতল পাটি তৈরী হয়) বাগান ছিলো। কিছুদিন আগে দেখে এলাম হিজল বাগানও নেই,মুক্তার জঙ্গলও নেই।
যাহোক, মুক্তিযোদ্ধাদের সারি'র লেজের অংশটি তখনো কান্দাপাড়া থেকে দেখা যায়। আবার হঠাৎ করে মেদিনী কাঁপিয়ে বিমানের আগমন। ভুল বুঝাবুঝি'তে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউকেউ বিমানের দিকে গুলাগুলি শুরু করে দিলো। কিছু পরে আবার থেমেও গেলো। বিষয়টা সেমসাইড হয়েছিলো। ওগুলো মিত্রবাহিনীর বিমান ছিলো।
সেদিনের কয়েক ঘন্টার যুদ্ধেই ধর্মপাশা মুক্ত হয়ে গেলো।শুনলাম পাকবাহিনী মোহনগঞ্জের দিকে পিছু হটেছে।
আব্বা বললেন, তোমরা থাকো, আমি বাড়ী যাই,ঘর বাড়ির অবস্থাটা গিয়ে দেখি। আমিও জেদ ধরলাম, আমিও বাড়ী যাবো। দুই বাপ-পুত রাতেই ধনপুর পূর্ব পাড়ায় ফুফুর বাড়ীতে এসে পৌছালাম।
ভোর হতে না হতেই মোহনগঞ্জ বাজার থেকে জয়বাংলা ধ্বণি ভেসে এলো। মোহনগঞ্জ শত্রুমুক্ত। আমরা স্বাধীন।
#পাদটীকাঃ হাজি টুকানো বা হাজি কুড়ানো অর্থ হলো শুকনা দূর্বাঘাস কুড়ানো বা টুকানো। কান্দাপাড়া সহ ঐ অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দ এটা। হাজি অর্থ শুকনা দূর্বাঘাস। যা দিয়ে রান্না করা হয়।

আমাদের বাড়ীর পশ্চিম দিকে একদম আমাদের ঘর ঘেঁষে একটি খাল আছে। খালের ওপাড়ে কিছুটা দূরেই রাজ্জাক মেম্বারের বাড়ী। তিনি রাজ্জাক মেম্বার নামেই কথিত ছিলেন। বেশ দাপুটে লোক বলে এলাকায় তার কদর ছিলো বেশ।
রাজ্জাক মেম্বার রাজাকার ছিলেন। আলোকদিয়ায় দুজন বড় রাজাকার ছিলেন, একজন রাজ্জাক মেম্বার এবং অন্যজন মোরগ ব্যবসায়ী দুদু মিয়া। এই দুজন রাজাকার হলেও এলাকার কারো ক্ষতি তারা করেননি। আমার বাপ-মা সহ বড়দের মুখে তাদের সম্পর্কে কোন মন্দ কথা শুনিনি। উল্টো এমন কথা শুনেছি যে, তারা দুজন রাজাকার হওয়ায় এলাকার মানুষ পাকবাহিনীর অত্যাচার,উৎপাত থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়েছে।
যাহোক, ৮'ই ডিসেম্বর একযুগে মোহনগঞ্জ, ধর্মপাশা এবং বারহাট্টা মুক্ত হলে রাজ্জাক মেম্বার পালিয়ে যান। এর কয়েকদিন পরই শুনতে পাই তিনি ধরা পড়েছেন। আমরা তখন গ্রামের পূর্ব পাড়ায় ফুফুর বাড়ীতে থাকি। কারণ ইতিপূর্বে আমাদের বাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
একদিন বিকাল বেলা আমাদের পাড়ায় হঠাৎ হৈচৈ। রাজ্জাক মেম্বার কে ধরে এদিকে নিয়ে আসা হচ্ছে। ফুফুর উঠান দিয়ে আমাদের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মজিবুর রহমান ওরফে চন্দুমিয়া এবং আরও দু'তিনজন মুক্তিযোদ্ধা উদোম শরীরের রাজ্জাক মেম্বার'কে পিঠমোড়া করে বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাজ্জাক মেম্বার ছিলেন উঁচালম্বা স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ। তাকে উদোম গায়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে আমার ফুফু তো মাথা ঘুরে চিৎপটাং।
সকালে শুনলাম আমাদের গ্রামের দিকে কংশ নদীর ঢালে রাজ্জাক মেম্বার'কে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে। বাড়ীতে লাশ আনার পর দেখতে গেলাম। আলোকদিয়া ধনপুর ছাড়াও পাশের আরও কয়েক গ্রামের অনেক মানুষ দেখতে এলো।
এখনো আমার চোখে ভাসে, লাশের পেটে কোন নাড়ীভুঁড়ি নেই। শুধু উঁচু বুকের ছাতিটা আছে। শিয়ালের পাল রাতেই নাড়ীভুঁড়ি খুবলে খেয়েছে।
রাজ্জাক মেম্বারের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় ছেলের নাম সবুজ মিয়া। সে আমার সমবয়সী। একই পাড়ার হওয়ায় তার সাথে আমার খুব সখ্যতা ছিলো। আমরা একসাথে খেলতাম,স্কুলে যেতাম এবং একই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তাম।
একদিন সবুজের মা আর আমার মা মিলে দু'জনের দোস্তি পাতিয়ে দিলো। বড় হয়ে "রাজাকার" শব্দটার তাৎপর্য বুঝলাম বটে,কিন্তু সবুজের সাথে দোস্তিটা আমি বাদ দিতে পারলাম না। ততদিনে অন্যরকম একটা অনুভুতি,দরদ ও মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে গেছি দুজনে।
আমি চাকরিতে আসার পর সবুজের সাথে যোগাযোগ খুব কম হতো। কালেভদ্রে মোহনগঞ্জে গেলেটেলে দেখা স্বাক্ষাত হতো। কয়েক বছর আগে সবুজ মারা গেছে। শেষ দেখা হয়নি। কারণ তার মৃত্যুর অনেক পড়ে আমি খবরটা পাই।
সবুজ খুব মেধাবী ছিলো। তার হ্যান্ডরাইটিং ছিলো চমৎকার। কিন্তু লেখাপড়া করতে পারেনি। কেনো পারেনি, জানি না। আল্লাহপাক দোস্ত সবুজকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
 

লিখেছেন-

আবুল কালাম আজাদ

 

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo