খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি ভাবতে হবে নিরাপদ খাদ্যের কথা

শাইখ সিরাজ

ঊর্ধ্বমুখী জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই আমাদের ভাবতে হয়েছে অধিক উৎপাদনশীলতার কথা। নতুন জাত আবিষ্কার করতে গিয়ে, পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করতে গিয়ে কিংবা দীর্ঘদিন খাদ্য সংরক্ষণ করতে গিয়ে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হয়েছে। এতে খাদ্য অখাদ্য হয়ে যায়নি। অসৎ মানুষ খাদ্যকে অনিরাপদ করে তুলেছে। অসৎ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থেকে খাদ্যকে বিষাক্ত করে তোলা হয়েছে। আর এ কাজে কেউ যুক্ত হয়েছে জেনে, আর অনেকেই যুক্ত হয়েছে না জেনে।

আপনি যে কোনো গ্রামে ফসলের মাঠে কৃষকের কাছে জানতে চান, ‘পোকা দমনের জন্য ফসলে কী দিয়েছেন?’ সে উত্তরে বলবে, ‘ওষুধ দিয়েছি।’ ‘ওষুধ’- সে তো নিরাময় দেয়। কৃষক জানে ওষুধে ক্ষতি নেই। কৃষক যখন ফসলের কীটের আক্রমণে দিশাহারা তখন তাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য কেউ ছিল না। না সরকারি লোক, না উন্নয়ন সংস্থার কেউ। তার কাছে গিয়েছে কীটনাশক কোম্পানির বিক্রেতা, যে কৃষকের হাতে কীটনাশক ধরিয়ে দিয়ে ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে বলেছে। যত বেশি ব্যবহার হবে তত বেশি লাভ কীটনাশক বিক্রেতার। অথচ কৃষক শুধু চেয়েছে তার ফসল ভালো  হোক। আমি গ্রামের মাঠে দেখেছি, কৃষক খেতে কীটনাশক প্রয়োগের সময় গ্লাভস-মাস্ক ব্যবহার করে না। এমনকি কাঁধের গামছাটা দিয়েও নাক-মুখটা ঢেকে নেয় না। কারণ সে এ বিষয়টা সম্পর্কে জানে না। অথচ আমাদের নিজেদের স্বার্থেই প্রয়োজন ছিল কৃষককে সচেতন করা। আমরা কি সেটা করেছি?

‘কৃষি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপারের প্রতি আমাদের ব্যাপক উদাসীনতা। আমরা উন্নয়নের কথা ভাবতে গিয়ে ভেবেছি রাস্তাঘাট, কলকারখানাসহ বিশাল সব স্থাপনার কথা। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি খাবারটা নিরাপদ না হলে, কোনো অর্জনই টিকবে না। খাদ্য ঠিক রাখে মানুষের স্বাস্থ্য, মানুষের স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে উন্নয়ন টিকবে কী করে! এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের একটা গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য সেফ ফুড ইমপারেটিভ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম। বিশ্বব্যাংক বেশ কয়েকটি দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণা করেছে। সে গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যেসব দেশের মানুষ নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে অসচেতন তাদের উৎপাদনশীলতা তুলনামূলকভাবে কম। উন্নত দেশগুলোর মানুষ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মানুষের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করে। তার পরও তাদের গড় উৎপাদনশীলতা বেশি। আর এর প্রভাব পড়ছে আমাদের অর্থনীতিতে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে আমাদের যতটা এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল তা পারছি না। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে- অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিনিয়তই উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের মানুষ যে উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে তাকে আর্থিকভাবে হিসাব করলে পরিমাণ দাঁড়ায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। টাকার অংকে ১২ হাজার কোটি টাকা। তার মানে শুধু নিরাপদ খাদ্য খেলেই বাংলাদেশের মানুষ জিডিপিতে আরও ১২ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে পারত। সাধারণ মানুষ কি ‘নিরাপদ খাদ্য’-এর ব্যাপারে সচেতন? না, মোটেও না। দেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন গ্রামে আমার ছুটে যেতে হয়। প্রতিনিয়তই অনেক মানুষের সঙ্গে আমার কথা বলতে হয়। আমি অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি, ‘আপনারা যা খাচ্ছেন, তা নিরাপদ কি না ভেবেছেন?’ এ ব্যাপারটা নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। তারা জানে না অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের কারণে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে, ফলে তাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। অতি সম্প্রতি কক্সবাজারের শুঁটকিপল্লীতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। খোলা আকাশের নিচে লাখ লাখ মাছ রোদে শুকানো হচ্ছে। শুঁটকি উৎপাদনকারীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘এখনতো মাছের শুঁটকি উৎপাদনে নানা প্রযুক্তি আছে, যাতে মাছের শুঁটকিটা নিরাপদ থাকে। আপনারা সেগুলো কেন ব্যবহার করেন না?’

উত্তরে বলল, ‘ওগুলোতে আমাদের পোষাবে না। যে পরিমাণ শুঁটকি আমরা উৎপাদন করি, তাতে ওসব মেশিন-টেশিনে হবে না।’ আসলে তাদের বাণিজ্য ঠিকঠাক চলছে। মানুষের হাতে যা তুলে দিচ্ছে, মানুষ তা দেদার কিনে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষ যদি সচেতন হতো, অনিরাপদ শুঁটকি না কিনত ঠিকই তারা নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনে মনোযোগী হতো। তবে আশার কথা হচ্ছে, নিরাপদ খাদ্যের কথা ভাবছে অনেক তরুণ। তারা বিষ বা রাসায়নিক প্রয়োগ না করে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে উদ্যোগী হচ্ছেন। ঢাকার মিরপুরে পারভীন আক্তার নামের এক উদ্যোক্তার ঘরের ভিতর সবজি উৎপাদনের একটা প্রকল্প দেখার সুযোগ হয়েছিল। একটি পরিত্যক্ত বাড়ি ভাড়া নিয়ে চার তরুণ উদ্যোক্তা সেখানে গড়ে তুলেছে ভার্টিক্যাল ফার্ম। ঘরের ভিতর হাইড্রোপনিক সিস্টেমে ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে উৎপাদন হচ্ছে লেটুস, বক চয়, বেসিল, সেলারি, ক্যাপসিকাম ও চেরি টমেটোসহ বেশ কয়েক রকমের সালাদ ও সবজি ফসল। এ আয়োজন উন্নত বিশ্বের সর্বাধুনিক কৃষি আয়োজনগুলোর মতোই। পরিমিত আলো ও তাপের জন্য ব্যবহার হচ্ছে বিশেষায়িত এলইডি আলো। চার উদ্যোক্তার অন্যতম পারভীন আক্তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করা এ উদ্যোক্তা কাজ করেছেন দেশি-বিদেশি নানান গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে। এমনকি শৈশব থেকে বেড়েও উঠেছেন শহরে। কিন্তু টেলিভিশনের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানে দেখা আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তির কৃষি অনুশীলন তাকে দারুণভাবে মোহিত করে। তার চিন্তায় আগামীর কৃষি বাণিজ্যের একটা রূপ বাস্তবিক ও প্রায়োগিকভাবেই প্রতীয়মান হয়। এ প্রসঙ্গে কালিয়াকৈরের ইমরুল হাসানের কথাও বলতে চাই। তিনি ২০০৩ সালে বুয়েট থেকে পাস করে দীর্ঘদিন দেশে-বিদেশে টেলিকম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। কর্মসূত্রে যুক্তরাজ্য, মিসর, ফিলিপাইন, আরব আমিরাতে অবস্থান করার পর ২০১৪ সালের শেষদিকে দেশে ফেরেন। তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন ও কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগে সম্পৃক্ত হন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে একাধিক উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর ২০২০ সালে শুরু করলেন মুরগির খামার। তাঁর খামারের বিশেষত্ব হচ্ছে তিনি কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করবেন না। শতভাগ অর্গানিক উপায়ে লালন-পালনের উদ্যোগ নিয়েছেন। পারভীন বা ইমরুলের মতো অনেক তরুণই এগিয়ে আসছেন। ‘গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস’ অনুসরণ করছে তারা। ফলে ফসলের বিশুদ্ধতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই থাকছে না।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, স্বল্পোন্নত এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোর সাধারণ মানুষ অনিরাপদ খাদ্য খাওয়ার কারণে প্রতি বছর যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তার আর্থিক পরিমাণ ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। খাদ্য গ্রহণে সচেতন হলে এ পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ শীর্ষক আমাদের একটি আইন রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে সেই আইন কার্যকর করা হয়। এ আইন অনুযায়ী খাদ্যে ভেজাল করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। নিরাপদ খাদ্যের মান নিশ্চিত করতে ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা’ ও ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ গঠনের কথাও উল্লেখ আছে। সাধারণত রমজানের আগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হতে দেখি। হোটেলগুলোকে কিছু জরিমানা করা হয়। গত বছর খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল সারা দেশে ৭১টি ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ গঠন করা হয়েছে। তাদের কার্যক্রম কতদূর এগুলো জানি না। কথা হচ্ছে, খাবারে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কোটি কোটি মানুষকে নীরবে হত্যা করা হচ্ছে, এর জন্য সামান্য জরিমানা করা হচ্ছে। অথচ এর জন্য প্রয়োজন আরও কঠোর আইন এবং আইনের যথার্থ প্রয়োগ। যদিও প্রচলিত আইনটি যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না।

বছর দশেক আগেও উত্তরবঙ্গের বিভীষিকার নাম ছিল ‘মঙ্গা’। আমরা আজ ওই দুঃসময় অতিক্রম করে এসেছি। বলা চলে দেশ খাদ্যে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। করোনাকালে আমরা দেখেছি অনেক উন্নত বিশ্বকে খাদ্য ঘাটতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আমাদের সেসব কোনো সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়নি। মনে পড়ছে বছর চারেক আগে কুড়িগ্রামের এক কৃষককে তাদের খাবার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আগে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল কী খাব আর এখন প্রশ্ন হচ্ছে কী দিয়ে খাব।’ ঠিক এমনভাবেই পাল্টেছে সব। আমরা খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্ন উতরে গেছি। এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘নিরাপদ খাদ্য’। আমি আমার জায়গা থেকে চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান ও পত্রিকার কলামে মানুষকে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে সচেতন করার প্রয়াস চালিয়ে আসছি। নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্নে সবাই সরব হতে হবে।  মাদক যতটা ভয়ানক, তার চেয়েও বেশি ভয়ানক খাবারের বিষ। মাদক রোধে আমরা যতটা সোচ্চার তার এক দশমাংশও সচেতন নয় অনিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। মানুষকে সচেতন করা ছাড়া কোনো সামাজিক আন্দোলনই সফল হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে। ঠিক তেমনি ভূমিকা আছে গণমাধ্যমসহ সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের।

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo