নাজমুলের হাতে বাংলাদেশ দলকে তুলে দেওয়ার এখনই সময়

মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না। নিউজিল্যান্ড তখন টেস্ট ক্রিকেটের অফিশিয়াল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। দেশের মাটিতে এর আগের প্রায় তিন বছরে টেস্ট হারেনি। সেই জয়ের মহিমা বোঝাতে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, বাংলাদেশ এর আগের ২০ বছরে নিউজিল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কোনো ম্যাচই জেতেনি। কী ভয়ংকর এক স্কোরলাইন—নিউজিল্যান্ড ৩২-বাংলাদেশ ০। এসব মনে রাখলে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে বাংলাদেশের জয় এত দিন পরও ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। রূপকথা রূপকথা লাগে।

সিলেট টেস্টে বাংলাদেশের জয়কে তাহলে কী বলা যায়? বাংলাদেশে এসে ওয়ানডেতে অনেকবারই হেরেছে নিউজিল্যান্ড। টানা দুবার হোয়াইটওয়াশও। বাংলাওয়াশ কথাটার উৎপত্তিও ২০১০ সালে এর প্রথমটিতেই। যে ‘বাংলাওয়াশ’ কথাটা নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটমহলেও পরিচিত। তবে দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয় তো এই প্রথম এবং সেই জয় মিরপুরে নয়।

মিরপুরে যে নয়, এর অবশ্যই আলাদা তাৎপর্য আছে। এর আগে দেশের মাটিতে বাংলাদেশের স্মরণীয় দুটি টেস্ট জয়ের দুটিই মিরপুরে। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড ও ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই দুই জয়েই উইকেটের বড় ভূমিকা। সিলেটের জয়টাকে একটু এগিয়ে রাখতে হয় উইকেটের কারণেই।

এই উইকেটেও স্পিনারদের জন্য যথেষ্টই সাহায্য ছিল। তবে মিরপুরের মতো তা ব্যাটিং করাটাকে বিশ্বের কঠিনতম কাজ বানিয়ে ফেলেনি। প্রথম দুই দিনের তুলনায় পরের তিন দিন বরং ব্যাটিং করাটা আরও সহজ হয়েছে। সিলেটের এই জয় তাই স্পিনিং উইকেটে অস্বচ্ছন্দ বিদেশি দলকে ধরেবেঁধে হারানোর মতো কিছু নয়। প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো ক্রিকেট খেলে যোগ্যতর দল হিসেবেই যা পেয়েছে বাংলাদেশ।

নিউজিল্যান্ডের পুরো শক্তির দল আর বাংলাদেশ দলে প্রথম পছন্দের পাঁচ–ছয়জন ছিলেন না—এটা আর নাই-বা উল্লেখ করলাম। মাউন্ট মঙ্গানুইয়েও তো বাংলাদেশ প্রথম পছন্দের একাদশ নামাতে পারেনি। মাউন্ট মঙ্গানুই বললে এখনো প্রথমেই মনে পড়ে সেই স্যালুট। মানে ইবাদত হোসেন আরকি! আর সিলেট টেস্টের কথা বললে?

তাইজুল ইসলামের জন্য বিশেষ বোনাস ঘোষণা করলেও ইবাদতের মতো স্যালুট দিতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। শোম্যানশিপ বলতে কিছুই নেই তাঁর মধ্যে। সাধকের মতো নীরবে নিজের কাজটা করে যাওয়াতেই তাঁর আনন্দ।

তবে তাঁর মতো করে উদ্‌যাপন তো তিনিও করেছেন। কখনো শূন্যে লাফিয়ে, কখনোবা দুই হাত মুঠো করে তীব্র চিৎকারে। সেই দৃশ্যগুলোও চোখে ভাসছে, তবে এখন যেমন, আজ থেকে অনেক দিন পরও এই সিলেট টেস্টের কথা উঠলে আমার প্রথমেই মনে পড়বে নাজমুল হোসেনকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা পালাবদলের শুরু হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে এই টেস্ট। যে পালাবদলের নায়ক হতে পারেন নাজমুলই। হতে পারেন কী, হওয়া উচিত।

বাংলাদেশের আগের স্মরণীয় টেস্ট জয়গুলোর কথা ভাবলে কোনোটিতেই প্রথমে অধিনায়কের কথা মনে পড়ে না। সিলেট টেস্টে যে তা পড়ছে, তাতে দ্বিতীয় ইনিংসে নাজমুলের সেঞ্চুরির অবশ্যই ভূমিকা আছে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার উদাহরণ হিসেবে আগে-পরে সেটির কথা আসতই। এমনকি ফুল টসে আউট হওয়া প্রথম ইনিংসটাও। ফুল টস মারারই বল।

এ দেশের অতি উৎসাহী ক্রিকেট সমর্থকেরা যতই অন্য রকম মনে করাতে চান, সত্যিটা হলো, ক্রিকেট ইতিহাসে ফুল টসে মারতে গিয়ে আউট হওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান নাজমুল হোসেন নন। তবে আউট হওয়ার আগপর্যন্ত যে ব্যাটিংটা করেছেন, সেটিই প্রতিপক্ষ শিবিরে যুদ্ধের বার্তাটা পৌঁছে দিয়েছিল। এসব ইনিংসের মূল্য শুধু রানসংখ্যায় লেখা থাকে না। পরের ব্যাটসম্যানদের মনে ছড়িয়ে দেওয়া আত্মবিশ্বাসের মূল্য কি আর পরিমাপযোগ্য!

অধিনায়কত্ব যে তাঁর ব্যাটিংয়ে কোনো প্রভাব ফেলে না, এর প্রমাণ আগেও দিয়েছেন। বিশ্বকাপের ঠিক আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব অভিষেকেই তো ৭৬ রান। যে ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল ২১। বিশ্বকাপে দুটি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন। একটিতে ৮, অন্যটিতে ৪৫। এমন কিছু নয়। যদিও রানআউট হয়ে না গেলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইনিংসটা ৪৫-এর চেয়ে আরও অনেক বড় হওয়ার সম্ভাবনা তো সুবাস ছড়াচ্ছিলই।

মনে রাখা দরকার, এই তিন ম্যাচেই হুট করে অধিনায়কত্ব করতে নেমেছেন। যাকে বলে, ঠেকার কাজ। পোশাকি ভাষায় ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক। সেই ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক সিলেট টেস্টে যেভাবে নেতৃত্ব দিলেন, তাতে এই ‘ভারপ্রাপ্ত’ কথাটা তুলে দেওয়া উচিত বলেই মনে হচ্ছে। ফিল্ডিং সাজানো, বোলিং পরিবর্তন, নিজে পারফর্ম করা—অধিনায়কত্বের এসব মৌলিক বিষয়ে লেটার মার্কস। তবে অধিনায়কের নেতা হয়ে উঠতে আরও কিছু লাগে।

ব্যক্তিত্ব, চিন্তার স্বচ্ছতা, আত্মবিশ্বাস, সাহস। পরের দুটি পুরো দলে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও। এখানেই ‘ক্যাপ্টেন্সি ম্যাটেরিয়াল’ হিসেবে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নাজমুল।ঠেকার কাজ চালাতে অধিনায়ক করা হয়েছে তাঁকে, দলে তারকা খেলোয়াড়দের অনেকেই নেই এবং খেলাটা টেস্ট ম্যাচ। অর্জনের বিচারে যেটিতে নিউজিল্যান্ড আর বাংলাদেশের কোনো তুলনাই চলে না। সিলেটে টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অধিনায়ক কী বলবেন, তা অনুমান করাই যায়। ‘ভালো খেলতে চাই’, ‘লড়াই করতে চাই’—এসব ভাববাদী কথাবার্তাই তো! অথচ নাজমুল কিনা ঘোষণা করে দিলেন, এই টেস্ট সিরিজটা বাংলাদেশের জেতা উচিত এবং তাঁর দল জেতার জন্যই খেলবে।

এটা বলার কারণেই বাংলাদেশ জিতে গেছে, এ দাবি অবশ্যই করা যায় না। এরপরও বাংলাদেশ হারতেই পারত। তবে অধিনায়কের প্রকাশ্যে এমন ঘোষণা দেওয়া তো অবশ্যই একটা বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয় দলে। নাজমুলের বলার ধরনটাও হুট করে মনে হলো আর বলে দিলাম এমন নয়।

কথাবার্তায় ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তার স্পষ্ট ছাপ, তা গুছিয়ে প্রকাশ করার ক্ষমতাও। ভালো অধিনায়ক হওয়ার জন্য অপরিহার্য এসব গুণের প্রমাণ গত বিশ্বকাপের সময় একাধিকবার পেয়েছি।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে নাজমুলই সবচেয়ে বেশিবার সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন। দল খারাপ করছে, তাঁর নিজের ব্যাটেও রান নেই—এসব সময়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া মানে অনেকটা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। প্রায় সব প্রশ্নই তো অপ্রীতিকর, সেসবও খুব সুন্দরভাবে সামলেছেন। নিজের যুক্তি দিয়েছেন, দেখিয়েছেন অকপটে ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়ার সাহসও। কখন কোনটা বলা যাবে, এই বিবেচনাবোধও খুব পরিষ্কার। অন্তত একটা উদাহরণ তো দেওয়াই উচিত।

বিশ্বকাপে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে এমন পাগলামি, যেটির সবচেয়ে বড় শিকার হয়তো নাজমুল নিজেই। ৩ নম্বরে খেলে আগের প্রায় এক বছরে বাংলাদেশের সফলতম ব্যাটসম্যান। অথচ তাঁকে সরে যেতে হচ্ছে সেখান থেকে। এ নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্নে দলের গানই গেয়ে গেছেন নাজমুল। ব্যাটসম্যানদের কারও কোনো সমস্যা নেই, সবাই এটা মেনে নিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নটা যখন আবার হলো, তখন বলে দিলেন, ‘ভবিষ্যতে এমন যত কম হয়, ততই ভালো। না হলে আরও ভালো।’

এর আগে যা বলেছেন, তা তাঁর মনের কথা ছিল না। তাঁর ব্যক্তিগত ভালো লাগা না লাগার চেয়েও গুরুত্ব পেয়েছে দলীয় সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তো আর সেই দায় নেই। তখন ঠিকই জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর ভাবনাটা। এই পরিণতিবোধ অন্য অনেক দেশের ক্রিকেটারদের জন্য হয়তো এমন বলার মতো কিছু নয়, কিন্তু বাংলাদেশে তো একটু বিরলই।

সিলেট টেস্ট জয়ের পর প্রতিক্রিয়াটাও মনে করে দেখুন না! পুরস্কার বিতরণীতে উপস্থাপকের কণ্ঠে মহা উচ্ছ্বাস, অথচ নাজমুল একেবারেই নির্লিপ্ত। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্টেই এমন একটা জয়ের পর উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়াটাই হতো স্বাভাবিক। তা তো যানইনি, উল্টো মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘জব হাফ ডান।’ মানে কাজ মাত্র অর্ধেক শেষ হয়েছে, পুরোটা হবে সিরিজ জিতলে।সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ দলকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব দিতে নাজমুল হোসেনকেই মনে হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত। সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপের পর আর ওয়ানডে অধিনায়কত্ব করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটেও কখন খেলবেন, কখন খেলবেন না, তার কোনো ঠিক নেই। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ দলকেই ধ্যানজ্ঞান করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করাটা অনেক দিনই সাকিবের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর তো আরও থাকবে না। এখনই তাই সময়, ঠেকার কাজ চালানোর বদলে নাজমুলকে দীর্ঘ মেয়াদে অধিনায়ক বানিয়ে তাঁকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়া।দীর্ঘ মেয়াদের কথা বলা হচ্ছে, যাতে নাজমুল নিজের মতো করে দলটাকে গুছিয়ে নিতে পারেন। ক্রিকেটে ভালো দল এভাবেই তৈরি হয়। বাংলাদেশে কোচ নিয়ে যত মাতামাতিই হোক, শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট তো অবশ্যই অধিনায়কের খেলা। সেই অধিনায়কত্ব-গুণের ঝলক তো বলতে গেলে প্রথম সুযোগেই দেখিয়েছেন নাজমুল হোসেন।

 

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo