ভাষার প্রাচীর ভাঙতে লড়ছেন তাঁরা

ভাষার প্রাচীর ভাঙতে লড়ছেন তাঁরা

- পিন্টু রঞ্জন অর্ক

 

প্রকাশঃ ১৩ মার্চ ২০২৪ইং

২০২০ সাল। লকডাউনে ক্যাম্পাস বন্ধ। বুয়েট থেকে তখন গ্রামে চলে গিয়েছিলেন অং শৈ সিং মারমা। একদিন এক শিক্ষকের অনুরোধে তাঁর শৈশবে পড়া স্কুলে ক্লাস নিতে গেলেন।

গণিতের ক্লাস। বোঝাচ্ছিলেন বাংলায়। খেয়াল করলেন, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তাঁর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না।

পরে আলাপ শুরু করলেন মারমা ভাষায়। এবার মারমা শিশুদের চোখেমুখে চাঞ্চল্য খেলা করল। কিন্তু উপস্থিত চাকমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা শিশুরা তাঁর কথার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না। প্রথমে শিক্ষার্থী এবং পরে শিক্ষকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলেন।

আরো ভালোভাবে পরখ করার জন্য দুর্গম পাহাড়ের বিভিন্ন স্কুলেও গেলেন। দেখলেন, সব জায়গায় সমস্যার ধরন প্রায় একই রকম। ভাষা প্রতিবন্ধকতার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়া বুঝতে পারছে না। মুখস্থবিদ্যার ওপর ভর করে পরীক্ষার বৈতরণী পার হচ্ছে তারা।

বান্দরবানের রোয়াংছড়ির ম্রংওয়া গ্রামে জন্ম অং শৈ সিংয়ের।

মা-বাবা দুজনেই জুম চাষি। বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। পরে ভর্তি হয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। বললেন, ‘শিক্ষকসংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা, আর্থিক দুরবস্থা তো আছেই। পাহাড়ি শিশুদের শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় অন্তরায় ভাষাগত সমস্যা। পাহাড়ে প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর শিশুরা তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলতে বলতে বড় হয়। কিন্তু স্কুলে গিয়ে তাদের বাংলা ভাষার মুখোমুখি হতে হয়।’

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ধরুন শিক্ষক চাকমা ভাষায় পড়াচ্ছেন। কিন্তু একই ক্লাসে মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, তঞ্চঙ্গ্যাসহ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর শিশুরা থাকে। ফলে চাকমা বাদে অন্যদের জন্য তা বোঝা কঠিন। বাংলায় লেখা পাঠ্য বইগুলো তাদের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। না বোঝার কারণে শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অনেকে অকালে ঝরে পড়ে। যদিও সরকার কয়েক বছর ধরে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্য বই দিচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত শিক্ষক তো নেই-ই, আবার অনেক শিক্ষক নিজেরাই পড়তে পারেন না সেই বই।’

 

ওরা ৭০ জন

অং শৈ ভাবলেন, মাতৃভাষায় পাঠদান করা গেলে এই সমস্যা কমবে। কিন্তু তাঁর পক্ষে স্কুলে স্কুলে গিয়ে তো আর পড়ানো সম্ভব নয়। তাই আশ্রয় নিলেন ইউটিউব, ফেসবুকের মতো মাধ্যমের। চো ওয়ং নয় এবং উবানু মারমার সহায়তায় বান্দরবান থাকার সময় নবম শ্রেণির গণিত বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায় ধরে ধরে ভিডিও বানানো শুরু করলেন। সেটা পরে আপলোড করতেন। পাশাপাশি বান্দরবানের বৌদ্ধ বিহারগুলোর হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীদের ক্লাসও নিয়েছিলেন। দেখলেন, মাতৃভাষায় বোঝালে সহজে ধরতে পারছে শিক্ষার্থীরা। নিজের মতো করে প্রশ্নও করছে।

পরে রাজধানীতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলেন। সবাই একবাক্যে সায় দিলেন। সবার সেই প্রচেষ্টারই ফসল নেখ্রে একাডেমি। তাঁদের এই কর্মকাণ্ডে পরে একে একে যুক্ত হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ জন শিক্ষার্থী। তাঁদের কেউ পড়াচ্ছেন, কেউ ভিডিও করছেন, কেউ এডিট করছেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আসা বিভিন্ন প্রশ্নেরও সমাধান দিচ্ছেন কেউ।

 

অন্ধকারে গন্ধরাজ

মারমা ভাষায় নেখ্রে শব্দের মানে আলোকরশ্মি। দুর্গম পাহাড়ে মাতৃভাষায় শিক্ষার আলো ছড়াবেন বলেই এমন নাম। আর তাঁদের প্রতিপাদ্য ‘মাতৃভাষায় শিখি’। অনলাইনভিত্তিক এই একাডেমি মূলত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত পাঠদানের প্ল্যাটফরম, যেখানে নিজ নিজ মাতৃভাষায় মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয় সহজভাবে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ফেসবুক, ইউটিউবের পাশাপাশি এখন ওয়েবসাইটও (www.nekhreacademy.com) আছে। মূলত ভাষাগত বাধা, শিক্ষকসংকট, স্কুলসংকটের কারণে পাহাড়ে শিক্ষার্থীরা যেসব সমস্যায় পড়ে, এই একাডেমির মাধ্যমে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছেন তরুণরা।

পরিচালকদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি বললেন, ‘দেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার সর্বোচ্চ পার্বত্য চট্টগ্রামে। এ ক্ষেত্রে ভাষা একটা বড় প্রতিবন্ধক। তাই পাহাড়ে শিক্ষার পথে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকগুলো উত্তরণে কাজ করা এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের ঝরে পড়া রোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

 

যেভাবে চলছে

ঢাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন থেকে একযোগে চলছে নেখ্রে একাডেমির কার্যক্রম। কনটেন্ট তৈরিতে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দেন শিক্ষার্থীরা। এখন মাধ্যমিক পর্যায়ের বিষয়গুলো, বিশেষ করে গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান নিজেদের ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করছেন তরুণরা। মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা—এই পাঁচটি ভাষায় কনটেন্ট তৈরি করছেন। অচিরেই খুমি, বম, পাংখোয়া, খিয়াং, লুসাইদের ভাষায় কনটেন্ট তৈরি করবেন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ইউটিউবে এখন পর্যন্ত দেড় শতাধিক কনটেন্ট আছে তাঁদের। এগুলো দেখেছে লাখো মানুষ।

এই একাডেমির একজন ইনস্ট্রাক্টর খাগড়াছড়ির মালাচিং মারমা। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পাবলিক হেলথের এই ছাত্রী বললেন, ‘আমরা বিষয়গুলো যার যার মাতৃভাষায় সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করছি। পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থীরা বাংলা বা ইংরেজিতে লিখবে। কিন্তু সে যেন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় করতে পারে সে চেষ্টা আমাদের। ঠোঁটস্থ নয় আত্মস্থ করাতে কাজ করছি আমরা।’

নেখ্রে একাডেমির কাজ পরিচালিত হয় ব্যক্তিগত অনুদানে। শুরুতে অং শৈ সিং, অনন্ত চাকমা ও নুং মং প্রু মারমা নিজেদের পকেটের টাকায় সব করেছেন। এক পর্যায়ে ক্যামেরাসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম কেনার জন্য ৬৮ হাজার টাকা লোনও নিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে বিজ্ঞানী ড. মংসানু মারমা, চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা, অধ্যাপক শায়েস্তাগির চৌধুরী, রানি উখেংচিং মারমা, পুচনু মারমা, উ ওয়ং শৈ মারমা, ঞোহ্লামং মারমাসহ অনেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। পরে অংকুর ফাউন্ডেশন এবং হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনও এই তরুণদের পাশে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুসাইমং মারমা বললেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রামে ঘর ভাড়া নিয়ে কনটেন্ট তৈরি করা যথেষ্ট ব্যয়বহুল ও চ্যালেঞ্জিং। যাতায়াত ও ট্রাফিক জ্যাম স্বেচ্ছাসেবকদের কষ্ট কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এর পরও তরুণরা শেকড়ের কথা ভোলেনি দেখে ভালো লাগছে।’ পৃষ্ঠপোষকদের একজন খাগড়াছড়ি মং সার্কেলের রানি উখেংচিং মারমা। এমআইটির এই গবেষক বললেন, ‘বুয়েট থেকে পাস করে নিজের ক্যারিয়ারের পেছনে না ছুটে অং শৈ সিং যেভাবে পাহাড়ের নতুন প্রজন্মের কথা ভেবেছে, তা অনুকরণীয়। ভাষাগত সমস্যাসহ পাহাড়ে শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অনেকে ঝরে পড়ে। সেদিক থেকে তরুণদের এই উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।’ 

 

অনেক পথ বাকি

যাদের হাতে ইলেকট্রনিক ডিভাইস আছে, তারা সহজে নেখ্রে একাডেমির ক্লাসগুলো দেখতে পারছে। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ে অনেক জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্কই নেই। সেখানে? অং শৈ সিং বললেন, ‘এখনো সবার কাছে পৌঁছাতে পারিনি। যাদের হাতে ডিভাইস নেই, বিশেষ করে পাহাড়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত হোস্টেলগুলোতে প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাঠদানের চেষ্টা করছি। রোজার ছুটিতে তিন পার্বত্য জেলায় সেমিনার করব। সাধারণত গণিত ও ইংরেজিতে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা দুর্বল। এ দুটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আরো আগ্রহী করতে অলিম্পিয়াডেরও আয়োজন করব। তবে ইচ্ছা থাকলেও অর্থাভাবে অনেক সময় চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। তাই পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কাজ আরো সহজ হবে আমাদের।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র নুং মং প্রু মারমা বললেন, ‘বাংলা চর্চা করতে করতে আজকাল পাহাড়ি শিশুরা নিজেদের মাতৃভাষা ভুলতে বসেছে। বলতে পারলেও অনেকে নিজেদের ভাষায় লিখতে ও পড়তে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাও হারিয়ে যাবে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে পাহাড়ি শিশুরা নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ পাচ্ছে, শিখতে পারছে। এ জন্য আমাদের ভাষা শিক্ষা কোর্সের কাজও চলমান।

 



 

Copyright © priyokagoj.com All Right Reserved.
Developed By Monoputo